কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে অনলাইনে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির সময় বয়স বিভ্রাটের কারণে আকবর আলী (৯৪) নামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে তার পুত্রের চেয়ে কম বয়স দেখানো হয়েছে। এমন জটিলতায় বন্ধ হয়ে যায় তার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলী বয়স সংশোধনের জন্য চেষ্টা করেও বিফল হন। গত ৪ ফেব্রুয়ারি মারা যাওয়ার আগেও সংশোধন হয়নি তার জাতীয় পরিচয়পত্রের ভুল জন্ম তারিখ। ফলে শেষ বয়সে বিভিন্নজনের কাছে দেনদরবার করেও সুরাহা না হওয়ায় অর্থ সংকটে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার চর ভূরুঙ্গামারী ইউনিয়নের ধুলারকুটি গ্রামের মৃত বাবন শেখের পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলী। প্রায় ৪৩ বছর বয়সে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সে সময় তিনি বিবাহিত ছিলেন। তার ৫ ছেলে ও ২ মেয়ে সন্তানের মধ্যে যুদ্ধের আগে তিন সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছিল।
মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকা ১৭নং বই ৪০১৪৭ ক্রমিক, লাল মুক্তিবার্তায় ৩১৬০৪০৫২০ ক্রমিক এবং ২০০৫ সালের ২১ মে বেসামরিক গেজেটের ৩৭৯১ পৃষ্ঠায় ১০৬৪নং তালিকায় তার নাম রয়েছে। তার জন্ম তারিখ ১৯২৮ সালের ১১ আগস্ট। তিনি ২০০৮ সালের ১ অক্টোবর থেকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেয়ে আসছিলেন। ২০২০ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য অনলাইনে পূরণ করতে গিয়ে তিনি জন্ম তারিখের ত্রুটির কারণে ভাতা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হন।
২০০৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির সময় তার বয়স তোলা হয়েছে ১৯৭১ সালের ১০ মে। আর বড় ছেলে আমির হোসেনের বয়স তোলা হয়েছে ১৯৬০ সালের ২ মার্চ। সে অনুযায়ী বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলী তার পুত্র আমির হোসেনের চেয়ে ১১ বছর ২ মাস ১১ দিনের ছোট।
পরিচয়পত্রে এমন বয়স বিভ্রাট নিয়ে এতদিন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা তুলে আসছিলেন আকবর আলী। কিন্তু ২০২০ সালে অনলাইনে তথ্য পূরণ করতে গিয়ে ভোটার আইডিতে জটিলতা থাকায় তার ভাতাটি বন্ধ হয়ে যায়। জন্ম তারিখ সংশোধনের জন্য ঢাকা, রংপুরসহ কুড়িগ্রাম নির্বাচন অফিসে ঘুরেও কোনো লাভ হয়নি। শেষ বয়সে এই বৃদ্ধ মানুষটি সবার কাছে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে সহযোগিতা চাইলেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সবাই। ফলে শেষ বয়সে রোগে-শোকে ভুগে তিনি গত ৪ ফেব্রুয়ারি প্রায় বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করেন বলে তার পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ তুলেছেন।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধার সহযোগী আরেক মুক্তিযোদ্ধা হযরত আলী জানান, আকবর আলী, লস্কর আলী এবং আমি পরস্পরের জ্যাঠাতো ভাই। তিনজনই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। আমরা মুক্তিযোদ্ধা ভাতাও পেয়ে আসছি। কিন্তু হঠাৎ আইডি কার্ডে সমস্যা হওয়ায় আকবর আলীর ভাতা বন্ধ হয়ে যায়। বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলীর স্ত্রী সুফিয়া বেওয়া বলেন, ভাতা বন্ধ হবার পর থেকে উনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অর্থাভাবে ঠিকমতো চিকিৎসা হচ্ছিল না। আমরা অফিস-আদালতে অনেক দৌড়াইছি। কিন্তু কেউ সাড়া দেয় নাই। শেষ পর্যন্ত মানুষটা অসুস্থ অবস্থায় মারা গেল।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলীর বড় ছেলে আমির হোসেন জানান, জাতীয় পরিচয়পত্র করার সময় বাবাসহ আমাদের অনেকের বয়স উল্টাপাল্টা করা হয়েছে। জন্ম তারিখ ঠিক করার জন্য যেখানেই গেছি শুধু টাকা-পয়সা চায়। শেষ পর্যন্ত আমরা ব্যর্থ হয়েছি। বাবা সংশোধনী না দেখেই মারা গেল।
সাবেক ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা ডেপুটি কমান্ডার জামাল উদ্দিন জানান, মৃত আকবর আলী একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তার বয়স ঠিক করার জন্য আমরা বহু চেষ্টা করেছি। কিন্তু কেন হলো না তা জানা নেই। তবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবি সঠিক তদন্ত করে মৃত মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলীর ভাতা পুনরায় চালু করার ব্যবস্থা করা হোক।
এ ব্যাপারে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম রাকিব জানান, বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবর আলীর জন্ম তারিখ সংশোধনের আবেদনটি “গ” ক্যাটাগরিতে বিবেচনা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ আবেদনটি নিষ্পত্তির জন্য প্রয়োজনীয় তদন্তসাপেক্ষে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে রংপুর আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা জিএম সাহাতাব উদ্দিন সমস্যাটি সমাধানের আশ্বাস দিয়ে বলেন, বিষয়টি আমার নজরে আসল। আমি যত দ্রুত সম্ভব সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করব।