ঢাকার গাবতলীতে অবস্থান করা ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে দুই বেলা খাবার তুলে দিচ্ছেন অসহায় ছিন্নমূল পথচারী স্কুলের শিক্ষকরা। পথশিশুদের পড়ালেখা, হাতের কাজের প্রশিক্ষণের সঙ্গে তাদের তিন বেলা খাবার নিশ্চিত করার পর করোনার প্রাদুর্ভাবকালে লকডাউন শুরুর পর অভুক্ত মানুষের মুখেও দুই বেলা খাবারের ব্যবস্থা করছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৬ সালে ‘জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু অসহায় ছিন্নমূল পথচারী স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। রোজীনা পরিবহনের শ্রমিক মো. আমিনুল ইসলাম এই স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। শুরুতে ১৫-২০ জন ছিন্নমূল পথশিশু নিয়ে শুরু করলেও বর্তমানে প্রায় ৬০ জন পথশিশু এখানে পড়ালেখা করছে। এদের পড়ালেখার পাশাপাশি তিন বেলা খাবার দেয়া হয়। তার সঙ্গে এসব শিশুদের কর্মমুখী করে তুলতে হাতেকলমে কারিগরি কাজের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
এসব শিশুরা বাস-টার্মিনাল, ফুটপাত ও রাস্তাঘাটে টোকাইয়ের কাজ করে থাকে। এসব শিশুদের এনে এ স্কুলে ভর্তি করা হয়। তাদের বাংলা, ইংরেজি, আরবি, অংক ও ক্রীড়া শিক্ষার সঙ্গে হাতের কাজ শেখানো হয়। এ স্কুলে মোট তিনজন শিক্ষক রয়েছেন। তারা বিভিন্ন পেশায় নিয়মিত থাকলেও পথশিশুদের সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরিতে কাজ করছেন।
দেশে করোনা পরিস্থিতি শুরুর পর অসহায় মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে ২০২০ সালের ২৬ মার্চ থেকে বিনামূল্যে রান্না করা খাবার বিতরণ কর্মসূচি শুরু করেন তারা। সেখানে পথশিশু, ভিক্ষুক, অসহায় মানুষ, প্রতিবন্ধী, পরিবহন-শ্রমিকসহ প্রতিদিন ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে দুপুরে ও রাতে খাওয়ানো হতো। বর্তমানে আর্থিক সংকটের কারণে প্রতিদিন দুই বেলা প্রায় ১৫০ জন করে খাওয়ানো হচ্ছে। তাদের প্রতিদিন দুপুরে ও রাতে রান্না করা সবজি¦, মাছ বা মাংস ভাত খাওয়ানো হয়। সবাই সারিবদ্ধ হয়ে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের পাশের একটি ফুটপাতে বসে খাবার খায়। এখানকার একটি খাবার হোটেলের মাধ্যমে খাবার রান্না করে বিতরণ করা হয়।
রোববার দুপুরে খাবার খাওয়ার সময় ইব্রাহিম নামে এক পথশিশু বলেন, ‘স্যাররা খাওন দেয় বইলা আমরা খাইতে পারতেছি, নাইলে না খাইয়া মরতে হইতো। হেরা (স্যাররা) আমগো পড়ায়, কাজ শিখায় আবার খাইতে দেয় বইলা বাঁইচা আছি।’
ইব্রাহিম বলেন, ‘আমরা টোকাইয়ের কাজ করি। আমগো কোনো বাড়িঘর নাই, গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে রাইতে ঘুমাই। সারাদিন পেলাস্টিক (প্লাস্টিক), লোহা টোকাইয়া যা পাই তা দিয়া দিন যায়। স্কুলে ভর্তি হওনের পর স্যারেরা পড়ালেহা ও কাম (কাজ) শেখাইতেছে। তার লগে তিন বেলা খাওন দেয় বইলা ভালা ভালা খাওন খাইতে পারতেছি।’
খাবার লাইনে বসে খাচ্ছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবী মজুমদার নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, গত তিন মাস ধরে বেতন বকেয়া হয়েছে। পকেটে টাকা নেই বলে বাড়ি যেতে পারছি না। মেস ভাড়া দিতে না পারায় বাসা ছেড়ে গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে থাকছি। এখানে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, খাবার দেয়া দেখে লাইনে বসলে এক প্লেট ভাত আর সবজি পেয়েছি, তা তৃপ্তি করে খাচ্ছেন বলে জানান।
তিনি বলেন, সমাজের ধনী মানুষরা গবীর আর অসহায় মানুষের কষ্ট বোঝেন না, গরীবরা গরীবের কষ্ট বোঝে বলে তারা আমাদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছে। যারা উদ্যোগ নিয়েছেন তাদের জন্য প্রাণভরে দোয়া ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি।
পথশিশু স্কুলের প্রধান-শিক্ষক মো. আল আমিন হাওলাদার বলেন, আমাদের সমাজে অনেক পথশিশু আছে যারা নানা ধরনের বাজে কাজে জড়িয়ে পড়ছে। ক্ষুধার জ্বালায় তারা যেকোনো কাজ করে থাকে। এতে করে সমাজে চুরি, ছিনতাই, মারামারি, হত্যাসহ নানা ধরনের ভয়ঙ্কর কাজ ও নেশার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। পেটের ক্ষুধায় তারা যেকোনো কাজ করতে পিছুপা হচ্ছে না। এজন্য পথশিশুদের পড়ালেখা শেখা ও কারিগরি শিক্ষা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয় এবং এসব শিশুদের তিন বেলা খাবার খাওয়ানো হয়ে থাকে।
তিনি বলেন, ২০১৬ সালে রোজীনা পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার আমিনুল ইসলাম এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে আমরা চারজন স্কুলটিকে চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। স্কুলটি চালিয়ে নিতে কেউ কেউ স্বল্প পরিমাণ সহায়তা দিলেও তা পর্যাপ্ত নয়। তা দিয়েই ছিন্নমূল শিশুদের পড়ালেখা ও খাবার খাওয়ানো হয়। তার ওপরে করোনা পরিস্থিতিতে আমরা অসহায় ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে দুই বেলা খাবার তুলে দেয়ার চেষ্টা করছি। শুরুতে অনেক মানুষকে খাওয়ানো সম্ভব হলেও বর্তমানে প্রতি বেলা দেড়শ জনকে খাওয়ানো হচ্ছে। সমাজের সচেতন ও সচ্ছল মানুষরা সহযোগিতার হাত বাড়ালে এ কার্যক্রম আরও বড় আকারে আয়োজন করা সম্ভব হবে জানান তিনি।
সহায়তা পাঠানোর ঠিকানা: মো. আল আমিন হাওলাদার, বিকাশ নম্বর ০১৭১৮৬৭৯১১২।