আগামী পাঁচ বছরের জন্য যারা চীন শাসন করবেন তাদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে ক্ষমতাসীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি)। এই পার্টির পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটি চীনের প্রেসিডেন্টের মন্ত্রিসভার সমকক্ষ। আর এই কমিটিতে যারা ঠাঁই পান তাদের দলের অভিজাতদের অভিজাত হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তবে দলের শীর্ষ এই কমিটিতে জায়গা পেতে কেবল দুর্দান্ত রাজনৈতিক রেকর্ড নয়, বরং অভ্যন্তরীণ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সুুনিপুণ কৌশল অবলম্বনেরও প্রয়োজন হয়।
মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সিপিসির স্ট্যান্ডিং কমিটিতে বড় ধরনের রদবদল অস্বাভাবিক নয় এবং এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এবারে যাদের বেছে নেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে ঝাও লেজি এবং ওয়াং হুনিং ছাড়া বেশিরভাগই দলে নতুন। তবে তাদের মধ্যে সবাই নয়, বরং অধিকাংশকে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের অনুগত হিসেবে দেখা হয়।
প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নেতৃত্বাধীন যে ব্যক্তিরা চীনের ক্ষমতার কেন্দ্র গঠন করেছেন, তারা কারা?
• লি কিয়াং
• বয়স: ৬৩
• বর্তমান রাজনৈতিক পদবী: চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাংহাই শাখার সেক্রেটারি
প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সবচেয়ে বিশ্বস্ত কনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে দেখা হয় লি কিয়াংকে। দেশটির ঝেজিয়াং প্রদেশের ছোট কাউন্টিতে কাজ করেছেন তিনি। শি জিনপিং ঝেজিয়াংয়ে পার্টি প্রধান থাকাকালীন তার চিফ অব স্টাফ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন লি।
চলতি বছরের শুরুর দিকে সাংহাইয়ে লি কিয়াংয়ের করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলার কৌশল নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল এবং সেখানকার বাসিন্দারা তার সমালোচনা করেছিলেন। এটি তার রাজনৈতিক ভবিষ্যতে প্রভাব ফেলতে পারে বলে সেই সময় জল্পনাও ছড়িয়েছিল।
কিন্তু কমিটিতে নতুন করে নিয়োগ পাওয়ায় এখন শি জিনপিংয়ের প্রতি আনুগত্য তাকে যে ভালো জায়গায় নিয়ে গেছে সেটি পরিষ্কার। সিপিসির স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যদের নিয়োগ আগামী বছরের মার্চে দেশটির সরকারের আইনসভার বার্ষিক অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করা হবে। অনেকের বিশ্বাস, লি কিয়াংই চীনের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন। আর এর মাধ্যমে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের পর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হবেন তিনি।
• ঝাও লেজি
• বয়স: ৬৫
• বর্তমান রাজনৈতিক পদবী: সেন্ট্রাল কমিশন ফর ডিসিপ্লিন ইন্সপেকশনের প্রধান
চীনা নেতৃত্বের একজন উদীয়মান তারকা হিসেবে দেখা হয় ঝাও লেজিকে। দেশটির শানঝি প্রদেশের সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে; যা অনেকটা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের মতোই।
চীনের কিংহাই প্রাদেশিক সরকারে জায়গা পাওয়ার পর সামনের দিকে তরতর করে এগিয়েছেন ঝাও লেজি। মাত্র ৪২ বছর বয়সে দেশটির সবচেয়ে কমবয়সী হিসেবে কিংহাইয়ের গভর্নর হয়েছিলেন তিনি। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থার প্রধান হিসাবে দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব ঝাওয়ের। বছরের পর বছর ধরে ঘুষ গ্রহণের দায়ে কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে কাঠগড়ায় তুলেছেন তিনি।
• ওয়াং হুনিং
• বয়স : ৬৭
• বর্তমান রাজনৈতিক পদবী: কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক পরিষদের ফার্স্ট সেক্রেটারি
সাবেক শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপক ওয়াং দেশটির জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদদের নজরে পড়ার পর দ্রুতই দলে জায়গা পান। চীনের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াং জেমিন তাকে দলে জায়গা দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন এবং জিয়াংয়ের পরামর্শক হিসাবেও নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক তাত্ত্বিক গুরু হিসাবে পরিচিত ওয়াং। অনেকে তাকে পার্টির নতুন নতুন ধারণার পেছনের মূল কারিগর হিসাবে বিবেচনা করেন। তার তত্ত্বের মধ্যে আছে তিন নেতার মতাদর্শ: জিয়াং জেমিনের তিন তত্ত্ব, হু জিনতাওয়ের উন্নয়ন সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং শি জিনপিংয়ের চিন্তাধারা।
চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভও তার মস্তিষ্কপ্রসূত ধারণা বলে মনে করা হয়। কমিউনিস্ট পার্টির সব শাখার সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক আছে বলে অনেকে ধারণা করেন।
• কাই কি
• বয়স: ৬৬
• বর্তমান রাজনৈতিক পদবী: বেইজিংয়ের মেয়র
চীনের প্রেসিডেন্ট শির ঘনিষ্ঠ মিত্র কাই কি। তিনি ফুজিয়ান এবং ঝেজিয়াং প্রদেশে শি জিনপিংয়ের অধীনে কাজ করেছেন। শুধু তাই নয়, চীনা নেতার প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্যের আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।
চলতি বছরের শুরুর দিকে যখন করোনাভাইরাস মহামারির প্রাদুর্ভাব তুঙ্গে সেই সময় বেইজিংয়ে শীতকালীন অলিম্পিক আয়োজনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। মহামারির মধ্যে অলিম্পিকের এই আয়োজন তখন পার্টির ‘সাফল্য’ হিসাবে দেখা হয় এবং পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটিতে জায়গা পাওয়ায় তার সেই সফলতার প্রতিফলনই ঘটেছে বলে অনেকে মনে করেন।
তবে তাকে নিয়ে বিতর্কও আছে। ২০১৭ সালে দেশটির রাজধানীতে তিনি জনসংখ্যার লাগাম টানার এক পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার পর তা নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছিল। তার ওই পরিকল্পনার কারণে অনেক নিম্ন-আয়ের উপার্জনকারী শহর ছেড়ে যেতে বাধ্য হন।
• ডিং জুয়েশিয়াং
• বয়স: ৬০
• বর্তমান রাজনৈতিক পদবী: প্রেসিডেন্টের কার্যালয় এবং সিপিসির সাধারণ সম্পাদকের কার্যালয়ের পরিচালক
একজন প্রশিক্ষিত প্রকৌশলী হিসাবে ডিংয়ের রাজনৈতিক কর্মজীবন শুরু হয়েছিল সাংহাইয়ের সরকারি এক গবেষণা কেন্দ্রে। প্রাদেশিক পর্যায়ের পার্টি সেক্রেটারি বা গভর্নর হিসাবে অভিজ্ঞতা (সাধারণত ক্ষমতায় আরোহণের জন্য অপরিহার্য বলে মনে করা হয় এই অভিজ্ঞতাকে) না থাকলেও তিনি ২০০৭ সালে শি জিনপিংয়ের ব্যক্তিগত সচিব নিযুক্ত হন।
২০১৪ সাল থেকে প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের প্রধানের দায়িত্ব পালিন করছেন তিনি। প্রেসিডেন্ট শির চিফ অব স্টাফ হিসাবেও কাজ করছেন তিনি।
শি জিনপিংয়ের চিন্তাধারার একজন শক্তিশালী সমর্থক তিনি। শির সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগীদেরও একজন এই ডিং। দেশে এবং বিদেশে জিনপিংয়ের অনেক সফরের সঙ্গী ছিলেন তিনি। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গত কয়েক বছরে চীনের অন্যান্য কর্মকর্তাদের চেয়ে শির সাথে সবচেয়ে বেশি সময় সম্ভবত ডিংই কাটিয়েছেন।
• লি শি
• বয়স: ৬৬
• বর্তমান রাজনৈতিক পদবী: চীনা কমিউনিস্ট পার্টির গুয়াংডং প্রদেশ শাখার সাধারণ সম্পাদক
চীনা নেতা শি জিনপিংয়ের পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে লির। ২০১৭ সালে লিয়াওনিং প্রদেশে এক ভুয়া অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান ঘিরে কেলেঙ্কারি তৈরি হয়েছিল। সেই সময় এই কেলেঙ্কারি মোকাবিলা করায় লিকে একজন সংকট-সমাধানকারী হিসাবে দেখা হয়।
রাজনৈতিকভাবে চীনের গুরুত্বপূর্ণ শহর ইয়ানানে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সিপিসির সদরদপ্তর হিসাবে এই শহরকে ব্যবহার করেছিলেন মাও সেতুং। আর বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং দলের জন্য এই শহরে সাত বছর কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন।
গুয়াংডং প্রদেশে প্রযুক্তি শিল্পের বিকাশ এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের নেতৃত্ব দিয়েছেন লি। নতুন বাণিজ্য নীতি প্রণয়ন এবং আঞ্চলিক একীভূতকরণের পক্ষে কাজও করেছেন তিনি।