চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমগাছ কেটে ফেলছেন আমচাষিরা। বর্তমানে ধানের মতো আম চাষ নিয়েও অনীহা লক্ষ্য করা গেছে তাদের মধ্যে। এ অবস্থা চলতে থাকলে জেলার আমনির্ভর অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যাবে। আম কেন্দ্রিক অর্থনীতিকে বাঁচাতে প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগসহ সম্মিলিত প্রচেষ্টা। যদিও এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছে কৃষি বিভাগ।
চাতরা গ্রামের আমচাষি মজিবুর রহমান। তিনি তার পাঁচ বিঘা জমির আমবাগান থেকে বছরে লাখ টাকা পেলেও পরিচর্যা খরচ বাদ দিয়ে প্রায় অর্ধেক টাকা ঘরে আনতে পারতেন। আবার কোনো কোনো বছর লোকসানও গুণেছেন। কিন্তু চলতি বছর বাগানের সব আমগাছ কেটে বিক্রির পর আমের কারণে বাকিতে কেনা সার ও কীটনাশকের দোকানের বকেয়া মিটিয়ে দিয়েছেন। এরপর যে টাকা ছিল, তা দিয়ে শুরু করেন সবজি চাষ। সবজি চাষে এখন তিনি স্বাবলম্বী।
তিনি বলেন, আমবাগান করব কুন দুঃখে? খালি (শুধু) লস আর লস। এখন হামি বাগুন (বেগুন) আর স্ট্রবেরি চাষ কর্যা ভালো আছি। নিজেও খ্যাতে পারছি, ফের বেচতেও পারছি। তিনি আরও জানান, তাদের পাঁচ বিঘা জমির প্রায় ১০০ আমগাছের সবগুলোই কেটে ফেলেছেন।
শুধু মজিবুর একা নন। আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জের অধিকাংশ ব্যবসায়ী গত পাঁচ বছর ধরে লোকসান গুণছেন। আমনির্ভর অর্থনীতির ওপর জেলার ৭০ ভাগ মানুষ নির্ভরশীল হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মহামারি, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল- বিশেষ করে পাশের জেলা নওগাঁয় আমের ব্যাপক চাষের কারণে আমের দাম পাচ্ছে না কৃষকরা। পরিচর্যা খরচ বাড়লেও সে অনুযায়ী আমের দাম না থাকায় আমবাগানগুলো এখন চাষিদের গলার কাঁটা। মূলত উৎপাদন যে হারে বেড়েছে, সে হারে চাহিদা না বাড়ায় এবং দেশের কয়েকটি জেলায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের আগেই আম বাজারজাত হওয়ায় দাম পাচ্ছেন না কৃষকরা। শুধু তাই নয়, নওগাঁসহ অন্যান্য জেলাগুলো ৫২ কেজিতে মণ ধরে আম বিক্রি করায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের কৃষকদেরও প্রতিযোগিতা করে একই পদ্ধতিতে আম বিক্রি করতে হচ্ছে। এতে করে প্রতারিত হচ্ছেন চাষিরা। আর এসব কারণেই একের পর এক বাগান কেটে ফেলছেন তারা।
বড় বড় বাগান এখন ধূ ধূ মাঠে পরিণত হয়েছে। সবজির দাম বেশি হওয়ায় কেউ কেউ বাগান কেটে সবজি চাষ করছেন। কেউ বা করছেন বিভিন্ন জাতের অসময়ের ফল ও হাইব্রিড আম চাষ। আবার অনেকে বেশি লাভের আশায় গড়ছেন বাণিজ্যিক ভবন।
জমির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় শিবগঞ্জের একাডেমি মোড়ে মঈন খানদের পারিবারিক আমবাগানের সব গাছ কেটে প্লট তৈরি করে বিক্রি করে দিচ্ছেন। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, এরই মধ্যে প্রায় ৫০টি আম গাছ কেটে ফেলে মাটির ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। দেওয়া হয়েছে প্লট বিক্রির সাইনবোর্ড।
পাশের আমবাগানের মালিক ইসমাঈল হোসেন শামিম তার বাগানের চার ভাগের তিন ভাগ আম গাছ কেটে তৈরি করছেন হাইব্রিড আমের বাগান। আল্ট্রা হাই ডেনসিটি পদ্ধতিতে আমবাগান করে তিনি স্বপ্ন দেখছেন বিগত বছরগুলোর ক্ষতি পুষিয়ে লাভের মুখ দেখার।
এ ব্যাপারে আমচাষি ইসমাঈল হোসেন শামিম বলেন, এ পদ্ধতিতে অসময়ে অল্প জায়গায় কম পরিচর্যা ও খরচে অনেক বেশি আম পাওয়া যাবে। তাই বাগানের ১০টি আম গাছ কেটে ৩০০ হাইব্রিড আম গাছ লাগিয়েছি। তিনি জানান, এ ধরনের বাগানের গাছগুলো সাইজে ছোট হওয়ায় কম সার ও সেচ দিতে হয়। শ্রমিক না পাওয়া গেলেও নিজে নিজেই পরিচর্যা করা যায়। এতে করে পরিচর্যা খরচও কম।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের আম চাষি মেহমুদ মিঞা জানান, বাগান পরিচর্যা খরচ বেশি হওয়ায় এবং কয়েক বছর ধরে আমের ন্যায্য দাম না পেয়ে তিনি তার ১০ বিঘা আমবাগানের গাছ কেটে ফেলেছেন। ওই জমি বিঘা হিসেবে ২০ হাজার টাকা করে এক বছরের জন্য ভাড়া দিয়েছেন এক সবজি চাষিকে।
একই এলাকার অপর আমচাষি মাসুদ রানা জানান, এভাবে আমচাষিরা লোকসান গুণতে থাকলে এক সময় আমচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। তাই দ্রুত আমের বহুবিধ ব্যবহার বাড়িয়ে আমের চাহিদা বাড়াতে হবে। আর উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি চাহিদা বাড়লে আমের দাম পাবেন চাষিরা।
এ ব্যাপারে বরেন্দ্র কৃষি উদ্যোগ ও কৃষি পণ্য বিতরণ সমবায় সমিতির সভাপতি তরুণ উদ্যোক্তা মুনজের আলম জানান, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সম্ভাবনাময় এ শিল্পটিকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। আর এ জন্য দেশের বাইরে আম রপ্তানি বাড়াতে হবে। রপ্তানি বাড়াতে হলে পরিবহন খরচ কমাতে হবে। আম থেকে বিভিন্ন ধরনের খাবর উৎপাদনে শিল্প উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসতে হবে। তবেই আমের চাহিদা বাড়বে। কৃষক আমের নায্য মূল্য পাবেন।
অপরদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. নজরুল ইসলাম জানান, জেলার নাচোল ছাড়া শিবগঞ্জ, গোমস্তাপুর, সদর ও ভোলাহাট উপজেলায় শুধু পুরাতন বড় বড় আম গাছ কাটা হচ্ছে। আমবাগান কাটা হলেও সেসব স্থানে লাগানো হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে হাইব্রিড জাতের আম গাছ। তাই জেলায় আমবাগান যেমন বাড়ছে, তেমনি উৎপাদনও বাড়ছে।
উৎপাদন বাড়লেও চাহিদা না থাকায় দাম না পাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একটি বড় আম না হওয়া আমগাছ কেটে অন্তত ১০টি হাইব্রিড আম গাছ লাগানোর ফলে উৎপাদন বাড়ছে। তাছাড়া সরকার সারে ভর্তুকি দেওয়ায় এবং কীটনাশকের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে থাকায় পরিচর্যা খরচ খুব একটা বাড়েনি।
তার দাবি, এ বছর আমবাগান ও আমের উৎপাদন দু’টিই বেড়েছে। কৃষকও অসময়ের আম উৎপাদন ও বেশি আম উৎপাদন করে বেশি লাভবান হচ্ছেন। সেই সঙ্গে আমের রপ্তানি বাড়াতে কৃষি বিভাগ এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। আর আম বিদেশে রপ্তানি বাড়লে কৃষক আমের দাম পাবেন।
কৃষি সম্প্রসারন কার্যালয়ের তথ্যমতে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩৮ হাজার হেক্টর জমিতে আমের চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে পুরনো গাছের সংখ্যা ৫০ লাখ। যার মধ্যে পাঁচ লাখ আম গাছ কাটা হয়েছে।