এর ফলে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ সংকট ও দাম বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে, বিশেষ করে আসন্ন রমজান মাসে। ব্যবসায়ীরা জানান, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষও খাদ্য খাতে ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে, যার প্রভাব আমদানি এবং বাজারের স্থিতিশীলতায় পড়ছে।
তিনি বলেন, ভারত থেকে আমদানি বন্ধের অজুহাতে চট্টগ্রামের পাইকারি বাজারগুলোতে আলু-পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। নগরীর খাতুনগঞ্জে গত সপ্তাহে প্রতি কেজি ভারতীয় পেঁয়াজ আকার ও মানভেদে ৮০-৮৫ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৯৫-৯৮ টাকায়। খুচরা বাজারে এসব পেঁয়াজ এখন বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়।
রিয়াজউদ্দিন বাজার আড়তদার কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ফারুক শিবলী বলেন, ভারত থেকে আলু রপ্তানি বন্ধ হওয়ার খবরে মুন্সীগঞ্জের কোল্ডস্টোরেজ মালিকরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর এ কারণে আমাদের এখানেও প্রভাব পড়েছে। নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারে সপ্তাহখানেক আগে প্রতি কেজি আলু ৫৯ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৬৫ টাকায়। খুচরা বাজারে সপ্তাহখানেক আগে কেজিপ্রতি আলু ৭০ টাকায় বিক্রি হলেও বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকায়।
অন্যদিকে, আমদানি হ্রাসের প্রভাবে চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেনার জাহাজ চলাচলের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। বন্দরের চিটাগাং কন্টেনার টার্মিনাল, নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনাল এবং পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালে জেটি অনুযায়ী জাহাজ নেই। বহির্নোঙরেও কোনো জাহাজ অপেক্ষমাণ নেই।
শনিবার (৩০ নভেম্বর) বন্দরের আরও জেটি খালি থাকবে। এমন তথ্য জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (পরিবহণ) এনামুল করিম। তিনি জানান, গত বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে কোনো কন্টেনার জাহাজ ছিল না। বন্দরের কন্টেনার জেটি হিসেবে ব্যবহৃত জেনারেল কার্গো বার্থের ১১ নম্বর জেটি এবং পতেঙ্গা কন্টেনার টার্মিনালের তিনটি জেটিই খালি ছিল। শুক্রবার একইসঙ্গে খালি হয়ে গেছে বন্দরের ৬টি জেটিও।
বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত বার্থিং মিটিং অনুযায়ী, শুক্রবার বন্দরের জেনারেল কার্গো বার্থের ৯, ১০ এবং ১১ নম্বর জেটি, চিটাগাং কন্টেনার টার্মিনালের ১ নম্বর জেটি, নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনালের ২ ও ৩ নম্বর জেটি জাহাজ শূন্য ছিল। শনিবার খালি থাকবে ১১ নম্বর জেটিও। শনিবারের মধ্যে ৭টি কন্টেনার জাহাজ বিদেশ থেকে এসে সরাসরি খালি জেটিগুলোতে বার্থিং নেবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ভাষ্য, জেটি খালি থাকছে এবং জাহাজ এসে অনঅ্যারাইভাল বার্থিং পাচ্ছে। আগের তুলনায় জাহাজ আসার পরিমাণ কমেছে। সম্প্রতিক স্বাভাবিক সময়ে বন্দরে একসাথে এতগুলো জেটি খালি থাকার নজির নেই।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সদস্য সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, আমদানি শ্লথ হয়ে পড়েছে এবং এই বার্তা আমরা বিভিন্নভাবে নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষকে দিয়েছি। এখানে গতি আনতে হবে। আগামী রোজার চাহিদা পূরণের জন্য সব ধরনের পণ্য ডিসেম্বরের মধ্যেই আমদানি নিশ্চিত করা উচিত।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের মতে, করোনাকাল থেকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের পর গত কয়েক বছর ধরে আমদানি ভোক্তার তুলনায় কম ছিল। এ জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে অস্থিরতা কমাতে পারেনি পূর্ববর্তী সরকার। এখন যে পরিমাণ আমদানি হচ্ছে তা-ও কম। এর অর্থ, অর্থনীতি দুর্বল অবস্থায় আছে এবং এটি তারই ইঙ্গিত।
তিনি বলেন, আগে ছিল বৈদেশিক মুদ্রা বা ডলার সংকট, এ কারণে পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে আমদানি সংকোচন করা হয়েছিল। এলসি মার্জিনও ছিল। কিন্তু এবার আমরা কী দেখছি? বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বেড়েছে এবং নীতিমালা শিথিল করা হয়েছে। তবুও আমদানিতে আশানুরূপ গতি ফিরছে না। এর অর্থ হলো চাহিদা কমে গেছে।
এর কারণ দুটি—
১. উচ্চ মূল্যস্ফীতি মানুষের প্রকৃত আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। খাদ্য কিনতে খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় সংকোচন করতে হচ্ছে। এটা কেউ কতটুকু করতে পারে? নিন্ম ও স্বল্প আয়ের মানুষ তো খাদ্যের বাইরে চিকিৎসা ও সন্তানের লেখাপড়া বাবদ ব্যয় করে। তারা ওই সব ব্যয় কমাতে পারে না। বাধ্য হয়ে খাদ্য ব্যয়ে তারা লাগাম টেনেছে। তারা কম ভোগ করছে বা চাহিদা কমিয়ে দিয়েছে।
২. আমদানিকারক এবং তার ব্যাংক বৈদেশিক ঋণ (সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট) পাচ্ছে না। কারণ থার্ড পার্টি হিসেবে যারা ঋণ দেয়, তারা এই মুহূর্তে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আশানুরূপ কিছু পাচ্ছে না। এর ফলে আমদানিকারকদের জন্য সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট পাওয়া সহজ হচ্ছে না।
অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, আমদানি তথ্য বলছে যে, দেশের অর্থনীতি সচল হয়নি। এর কারণ কী? আপনি যদি পথে-ঘাটে, অফিস-আদালতে, মার্কেটে নিরাপত্তার অভাব দেখেন, তাহলে আপনি কী করবেন? বাইরে যাবেন না। কাজ করবেন না। আয় করবেন না। ভোগ কম বা ত্যাগ করবেন। বিনিয়োগ নিয়ে ভাবনা বাদ দেবেন। এই তো হবে। তাই হচ্ছে। অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা ঠিক করতে হবে সবার আগে। আমাদের ইতিবাচক দুটি সূচক আছে। এর একটি হলো রেমিট্যান্স এবং অন্যটি রফতা। সুতরাং নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে শুরু করে এনফোর্সমেন্ট পর্যন্ত দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাহলে অর্থনীতি সচলতার দিকে এগিয়ে যাবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, নানা কারণে জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একটি বড় আন্দোলন হয়েছিল। সেই সময়ে পরিবহন, সরবরাহ ও উৎপাদনে স্থবিরতা ছিল। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, রিজার্ভ পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা- এসব কিছুর কারণে চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকটা মন্দা পরিস্থিতিতে গেছে।
তিনি বলেন, তবে আশা করছি নভেম্বর-ডিসেম্বরে অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়াবে। যদিও এখনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না। তবে আগামীতে পরিস্থিতি অনেক ভালো হবে, এ ব্যাপারে আমি আশাবাদী।
চট্টগ্রাম শাখার বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের এলসির মাধ্যমে আমদানি সংকুচিত হলেও আগামীতে তা বাড়ানোর লক্ষ্যে অনেক কিছু করা হচ্ছে।