বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে ঢাকার সাভার উপজেলা ও ধামরাইয়ে তল্লাশি জোরদার করেছে পুলিশ। তল্লাশি চলাকালে সাভারের আশুলিয়া, আমিনবাজার ও ধামরাই থেকে আজ শনিবার সকাল নয়টা পর্যন্ত শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে।
এদিকে ঢাকার প্রবেশমুখ আমিনবাজারে ঢাকামুখী সব গণপরিবহনকে ঠেকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেখানে এক দফা জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের। পরে গাবতলী সেতুর পার হয়ে আরেক দফায় পুলিশের জেরার মুখে পড়ছেন তাঁরা। তাঁদের কেউ কেউ অভিযোগ করেন, জিজ্ঞাসাবাদের নামে অযথাই হয়রানি করা হচ্ছে। পুলিশ সদস্যরা তাঁদের মুঠোফোন ঘেঁটে দেখেছেন।
গাবতলী সেতুর পাশে পর্বত সিনেমা হলের সামনে বসানো হয়েছে পুলিশের তল্লাশিচৌকি। সেখান থেকে সকাল পৌনে ১০টা পর্যন্ত কোনো গণপরিহন ঢাকায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ফলে অফিসযাত্রীসহ নানা কাজে ঢাকায় আসা যাত্রীদের পায়ে হেঁটে গন্তব্যের দিকে রওনা হতে হয়। কারণ, এ পাশেও রাস্তায় রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ অন্য কোনো যানবাহন প্রায় নেই বললেই চলে।
তবে পুলিশের দাবি, যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া সন্দেহভাজন হিসেবে জামায়েত ও বিএনপির নেতা-কর্মীসহ বেশ কয়েকজকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। আজ বেলা দুইটার দিকে রাজধানীর নয়াপল্টনে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে সমাবেশ করবে বিএনপি। একই সময় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ করবে আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া বেলা দুইটায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন দাবিতে মতিঝিলের শাপলা চত্বর এলাকায় মহাসমাবেশ করার কথা জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। তবে পুলিশ জামায়াতকে মহাসমাবেশ করার অনুমতি দেওয়ার কথা জানায়নি।
এদিকে মহাসড়কেও বাসের সংখ্যা অনেক কম। এ কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। অনেকেই লেগুনা, ইঞ্জিনচালিত রিকশায় করে গন্তব্যের দিকে যাচ্ছেন। তবে ঢাকাগামী যাত্রীদের আমিনবাজার ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসাপাতালের সামনে তল্লাশির মুখে পড়তে হচ্ছে। এ সময় অনেকেই গণপরিবহন থেকে নেমে হেঁটেই গন্তব্যের উদ্দেশে যাচ্ছেন।
তল্লাশি, আটক
আজ সকাল সাতটার দিকে সাভারের আমিনবাজার ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসাপাতালের সামনে গিয়ে দেখা যায়, ওই এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ঢাকাগামী লেনে তল্লাশিচৌকি বসিয়েছে ঢাকা জেলা পুলিশ। ঢাকার উদ্দেশে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ছেড়ে আসা বাস, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেল থামিয়ে যাত্রীদের অনেককেই নামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন পুলিশের সদস্যরা। পুলিশ সদস্যদের এ সময় তাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র, অফিসের পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স পরীক্ষা করতে দেখা যায়। এ ছাড়া সন্দেহভাজন হিসেবে অনেককেই নামিয়ে আমিনবাজার ২০ শয্যাবিশিষ্ট হাসাপাতাল চত্বরে নিয়ে যান পুলিশ সদস্যরা। ওই স্থানে প্রায় ৩০ জনকে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।
তল্লাশিচৌকিতে দায়িত্ব পালনকারী পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, সাভারে আমিনবাজার, বিরুলিয়া ও আশুলিয়া বাজার এলাকায় তল্লাশিচৌকিতে তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। গতকাল শুক্রবার দিবাগত রাতে আশুলিয়া বাজার এলাকার তল্লাশিচৌকিতে একটি বাস থেকে জামায়াতে ইসলামীর ৪৩ জন নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়।
ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস ও ট্রাফিক, উত্তর বিভাগ) মো. আবদুল্লাহিল কাফী বলেন, সাভারের তিনটি স্থানে তল্লাশিচৌকি বসিয়ে তল্লাশি কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। রাজধানীতে দুটি রাজনৈতিক দলের মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে কেউ যেন ঢাকায় প্রবেশ করে নাশকতা কিংবা বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করতেই এই তল্লাশি কার্যক্রম চলছে।
আশুলিয়ার জামায়াতের ৪৩ নেতা-কর্মীকে আটকসহ আমিনবাজারে তল্লাশি চলাকালে ৩৩ জনকে আটকের বিষয়ে আবদুুল্লাহিল কাফী বলেন, ‘যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে, আমরা তাঁদের গ্রেপ্তার করছি। আশুলিয়ায় আটকের সংখ্যাটি পরে জানানো হবে। আমিনবাজারে যাঁদের সন্দেহ হয়েছে, তাঁদের জিজ্ঞেসাবাদের জন্য কিছু সময় আমাদের হেফাজতে রাখা হচ্ছে। বিষয়টিকে এ মুহূর্তে আমরা আটক বলব না। তাঁরা ঠিকঠাক নাম-পরিচয় না বলায় থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’
জিজ্ঞাসাবাদের নামে হয়রানি করার অভিযোগ
এদিকে বাস থামিয়ে যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে অযথাই হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেক যাত্রী। সাভার থেকে ধানমন্ডি যাচ্ছিলেন শামিম আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এভাবে সবাইকে বাস থেকে নামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে হয়রানি করা হচ্ছে। অযথাই সময় নষ্ট করছে।’ সাভার থেকে ঢাকার গুলশানে যাচ্ছিলেন মো. নাদিম হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাস কম, তাই সাভার থেকে লেগুনায় আমিনবাজার পর্যন্ত আসছি। এখন হেঁটে গাবতলী যাব। ওখানে বাস পেলে গুলশান যাব।’
ঢাকার গাবতলীতে সেতু পার হওয়ার পর আর এগোতে পারছে না কোনো গণপরিহন। সেখানে বসানো হয়েছে পুলিশের তল্লাশিচৌকি। পুলিশ সদস্যরা বাসের যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন, তাঁদের মুঠোফোনও ঘেঁটে দেখা হয়েছে। সাভারের জাকারিয়া হোসেন যাবেন মিরপুর–১ নম্বরে বড় ভাইয়ের বাসায়। তিনি বাসে করে আসছিলেন। সকাল সাড়ে আটটায় ঢাকার আমিনবাজারে পুলিশের তল্লাশির মুখে পড়েন তিনি।
জাকারিয়া হোসেন বলেন, তল্লাশি সময় তাঁর মুঠোফোন ঘেঁটে দেখেছে পুলিশ। পরে হেঁটে আসেন গাবতলী। এরপর পর্বত সিনেমা হলের সামনে বসানো দারুস সালাম থানার চেকপোস্টে আবার জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েন তিনি। জানতে চাইলে দারুস সালাম থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমাদের নিয়মিত চেকপোস্ট বসানো হয়। এর অংশ হিসেবে আজও তল্লাশি চালানো হচ্ছে।’
তবে আজ সড়কে গাড়িঘোড়া কম বলে স্বীকার করেন তিনি। দূরপাল্লার নাবিল পরিবহনের সুপারভাইজার সাভারের তামিম আহমেদ। তিনি ঢাকা থেকে গাবতলী আসছিলেন বাসে করে। আমিনবাজারে তাঁকে বাস থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। পরে তিনি হেঁটে গাবতলী আসেন।
সাভারের নবীনগর থেকে ঢাকায় ইউনিহেলথের কার্যালয়ে আসছিলেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মী কাউসার নাহিন। তিনি বলেন, আমিনবাজারে তাঁর মুঠোফোন ঘেঁটে দেখা হয়েছে। পরে গাবতলী সেতুর এপার আসার পর আবার তল্লাশির মুখে পড়েন। এরপর পায়ে হেঁটেই কর্মস্থলের দিকে রওনা হয়েছেন। গাবতলীর কয়েকজন পরিবহনকর্মী জানান, গাড়ির সংখ্যা খুবই কম। সকালে হাতে গোনা কয়েকটা দূরপাল্লার গাড়ি ছেড়ে গেছে।
ধামরাইয়ে সড়কে ককটেল বিস্ফোরণ
এদিকে সকাল থেকে ঢাকার ধামরাইয়ের ইসলামপুর এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের ঢাকাগামী লেনে তল্লাশিচৌকি বসিয়ে বিভিন্ন পরিবহনে তল্লাশি চালাচ্ছে ধামরাই থানার পুলিশ। মানিকগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের দিক থেকে ছেড়ে আসা প্রতিটি বাসে তল্লাশি চালাচ্ছে তারা। তল্লাশিকালে বাস থেকে আটজনকে নামিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখে পুলিশ।
এর আগে সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে ধামরাই পৌরসভার বাজার রোড এলাকায় মমতাজ হাসপাতালের উত্তর পাশে পাকা সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ করে সড়কের ওপর ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় জড়িত দুজনকে আটক করেছে ধামরাই থানা–পুলিশ।
প্রত্যক্ষদর্শী পরিবহনশ্রমিক মো. খায়ের বলেন, সকালের দিকে কয়েকজন সড়কে পাশে জড়ো হন। পরে একটি টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। দুই থেকে তিন মিনিট অবস্থানের পর তাঁরা চলে যান। যাওয়ার সময় তাঁরা একটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটান। এ সময় তাঁরা খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করেন এবং সরকারবিরোধী স্লোগান দেন। ধামরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, ‘সন্দেহ হলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কিছু সময় লাগছে। বিষয়টিকে এখনই আটক বলা যাচ্ছে না।’
সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ঘটনাস্থল থেকে দুটি অবিস্ফোরিত ককটেল ও চারটি চকলেট বোমা উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িত দুজন বিএনপির পদধারী নেতা। আটক ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।