সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রথমসারির দৈনিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে সাম্প্রতিক ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ সম্পর্কে একটি কলাম লিখেছেন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। সেখানেই এই পূর্বশর্ত হিসেবে এসব পয়েন্ট এনেছেন তিনি। কলামে এসব শর্তের বিস্তারিত ব্যাখ্যাও দিয়েছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী।
কলামে নেতানিয়াহু মন্তব্য করেছেন, ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধের পর পশ্চিমতীরে ক্ষমতাসীন ফিলিস্তিনি কতৃপক্ষ (পিএ) গাজা শাসন করতে পারবে বলে মনে করেন না তিনি। কারণ পিএ’র সেই সক্ষমতা নেইh
প্রথম পূর্বশর্ত, অর্থাৎ ‘হামাসকে ধ্বংস করস’ সম্পর্কিত ব্যাখ্যায় নেতানিয়াহু বলেন, ‘গাজায় ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর চলমান অভিযানের মূল উদ্দেশ্য হামাসকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি এবং অন্য অনেক দেশ উদ্দেশ্যকে সমর্থন করেছে। তারাও চায়, এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী শেষ হোক। গাজায় হামাসের শাসন অবসান এবং তাদের সামরিক সক্ষমতা সর্ম্পূর্ণ নষ্ট করার মাধ্যমেই এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।’
‘আর এই লক্ষ্য অর্জন ব্যতীত আমাদের সামনে আর কোনো উপায়ও নেই। কারণ হামাসের নেতারা ইতোমধ্যে জানিয়েছেন, গত ৭ অক্টোবর যে হামলা হয়েছে— ভবিষ্যতে বার বার তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। সারাক্ষণ এই ঝুঁকির মধ্যে থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’
তবে হামাসের কব্জায় এখনও ইসরায়েল এবং অন্যান্য দেশের যে ১২৯ জন নাগরিক জিম্মি অবস্থায় রয়েছেন, কীভাবে তাদের মুক্ত করা হবে— সে সম্পর্কিত কোনো তথ্য নেতানিয়াহুর কলামে পাওয়া যায়নি। তেমনি ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের
দ্বিতীয় শর্ত ‘গাজাকে নিরস্ত্রিকরণ করা’র ব্যাখ্যায় নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘আমরা চাই না যে গাজা উপত্যকা হামলাকারীদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হোক। এ কারণে উপত্যকার পরিসীমা বা সীমান্তে একটি সাময়িক নিরাপত্তা জোন স্থাপন করা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে গাজা ও মিসরের মধ্যে যে সীমান্তপথ রয়েছে, সেই রাফাহ ক্রসিংয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো জরুরি। কারণ গাজায় অস্ত্রের চালান ঢোকে মূলত এই সীমান্ত দিয়েই।
‘আমরা যদি প্রত্যাশা করি যে (যুদ্ধ অবসানের পর) পিএ গাজায় এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করবে, তাহলে সেটি হবে দিবাস্বপ্ন। কারণ পিএ’র সেই সক্ষমতা কিংবা ইচ্ছে— কোনোটাই নেই।’
কলামে উল্লিখিত তৃতীয় পূর্বশর্তের ব্যাখ্যায় নেতানিয়াহু বলেন, ‘ফিলিস্তিনের স্কুলগুলোতে বাচ্চাদের অবশ্যই এটা শেখাতে হবে যে মৃত্যুর চেয়ে বেঁচে থাকা অনেক মূল্যবান এবং জীবনের যত্ন নেওয়া জরুরি। ফিলিস্তিনের ইমামরা সবসময় তাদের ধর্মীয় বক্তব্যে ইহুদিদের হত্যার পক্ষে উসকানি দেন— এটা বন্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে ফিলিস্তিনের সাধারণ জনগণ যেন সন্ত্রাসবাদে অর্থের যোগান দেওয়ার পরিবর্তে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইকে সমর্থন করে— সেজন্যও ফিলিস্তিনের সুশীল সমাজকে কাজ করতে হবে।’
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলীয় ইরেজ সীমান্তে অতর্কিত হামলা চালায় হামাস যোদ্ধারা। তারপর ওই দিন থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী। পরে ২৮ অক্টোবর থেকে অভিযানে যোগ দেয় স্থল বাহিনীও।
ইসরায়েলি বাহিনীর টানা দেড় মাসের অভিযানে কার্যত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে গাজা উপত্যকা, নিহত হয়েছেন ২০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। এই নিহতদের ৭০ শতাংশই নারী, শিশু,অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর-কিশোরী এবং বয়স্ক লোকজন।
সেই সঙ্গে আহত হয়েছেন আরও ৫২ হাজার ৫৮৬ জন এবং এখনও নিখোঁজ রয়েছেন ৬ হাজার ৭০০ জন।। এছাড়া হাজার হাজার পরিবার বাড়িঘর-সহায় সম্বল হারিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বিভিন্ন স্কুল, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল প্রাঙ্গণে।
অন্যদিকে, হামাসের গত ৭ অক্টোবরের হামলায় ইসরায়েলে নিহত হয়েছিলেন ১ হাজার ২০০ জন ইসরায়েলি ও অন্যান্য দেশের নাগরিক। পাশাপাশি, ইসরায়েলের ভূখণ্ড থেকে ২৪২ জন ইসরায়েলি ও অন্যান্য দেশের নাগরিকদের সেদিন জিম্মি হিসেবে ধরে নিয়ে গিয়েছিল হামাস যোদ্ধারা।
এই জিম্মিদের মধ্যে ইসরায়েলিদের সংখ্যা ১০৪ জন। বাকি ১৩৬ জনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স, আর্জেন্টিনা, রাশিয়া ও ইউক্রেনের নাগরিকরা রয়েছেন; এবং রয়েছেন শিশু, নারী, তরুণ-তরুণী এবং বৃদ্ধ-বৃদ্ধা— সব বয়সী মানুষ।
টানা দেড় মাস ভয়াবহ যুদ্ধ শেষে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নতিস্বীকার করে গত ২৫ নভেম্বর অস্থায়ী বিরতি ঘোষণা করে হামাস-ইসরায়েলি বাহিনী। পরে ১ ডিসেম্বর দু’পক্ষের পারস্পরিক হামলার শুরুর মধ্যে দিয়ে শেষ হয় সেই বিরতি।
৭ দিনের অস্থায়ী বিরতির সময় নিজের কব্জায় আটক জিম্মিদের মধ্যে থেকে ১১৮ জনকে মুক্তি দিয়েছে হামাস; বিপরীতে এই সময়সীমায় ইসরায়েলের বিভিন্ন কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ১৫০ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, এখনও হামাসের কব্জায় রয়েছেন অন্তত ১২৯ জন জিম্মি। তাদের কীভাবে মুক্ত করা হবে, সে সম্পর্কে নেতানিয়াহুর কলামে কোনো নির্দেশনা বা ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।
সেই সঙ্গে ‘দ্বিরাষ্ট্র সমাধান’ বা আল-আকসা ভূখণ্ডে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যে আলোচনা চলছে— কলামে তাও এড়িয়ে গেছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী। নেতানিয়াহু অবশ্য বরাবরই ‘দ্বিরাষ্ট্র সমাধান’ তত্ত্বের ঘোর বিরোধী।