ঘন তমসাচ্ছন্ন এক রাত নেমে এসেছিল এই ভূখণ্ডে। মর্মন্তুদ সেই রাতের স্মরণে ২০১৭ সাল থেকে পালিত হচ্ছে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস।’ এর পর থেকে প্রতি বছরই ২৫ মার্চের কালরাতে এক মিনিটের জন্য নিষ্প্রদীপ হয়ে যায় সারাদেশ। আঁধারবিনাশী চেতনার আলোয় দীপ্ত স্তব্ধতার এ আয়োজন হয় একাত্তরে গণহত্যার শিকার শহীদদের স্মরণে।
কিন্তু গত বছরের মার্চ মাসে করোনা কালো থাবা বসিয়েছিল সারাদেশে। সেই থেকে সময় কাটছে নিঃসাড়ে। গত বছরের এই সময় লকডাউন থাকায় গণহত্যা দিবসে তেমন কোনো অনুষ্ঠান হয়নি দেশে। এবারও করোনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কিন্তু বাঙালি এবার করোনাভয় উপেক্ষা করে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই পালন করেছে ‘জাতীয় গণহত্যা দিবস’। একাত্তরের পঁচিশ মার্চের কালরাতে অপারেশন সার্চলাইটের অতর্কিত হত্যাযজ্ঞে হতচকিত ঢাকাবাসীর ঘরে ঘরে যে আলো নিভে গিয়েছিল, তারই স্মরণে এবার এক মিনিটের জন্য পুরো দেশে নির্বাপিত হয় যাবতীয় আলোকশিখা।
বৃহস্পতিবার রাত ৯টা থেকে ৯টা ১ মিনিট পর্যন্ত দেশের কোথাও কোনো আলো জ্বলেনি। গণহত্যা দিবসের জাতীয় কর্মসূচি হিসেবে গতকাল রাত ৯টা বাজতেই রাজধানীজুড়ে আঁধার নেমে আসে। দেশবাসীও নিজ নিজ বাতি নিভিয়ে ভয়াল রাতের স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনেন ক্ষণিকের জন্য।
গণমাধ্যমসহ যেসব প্রতিষ্ঠান রাতে চালু থাকে, তারাও এ কর্মসূচিতে অংশ নেয়। সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফির নেতৃত্বে সমকাল পরিবার তেজগাঁও কার্যালয়ের সামনে নীরবে দাঁড়িয়ে সব আলো নিভিয়ে শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। এ ছাড়াও দিনব্যাপী বিভিন্ন সভা-সেমিনার, মশাল প্রজ্বালনসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবিও উঠেছে অযুতকণ্ঠে। দিনভর বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠনের কর্মসূচিতে আলোক প্রজ্বালনের মাধ্যমে শহীদদের স্মরণ ছাড়াও ছিল আলোচনা সভা, গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র এবং আলোকচিত্র প্রদর্শনী।
এই দিন বাদ জোহর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে ২৫ মার্চের কালরাতে শহীদ সবার আত্মার মাগফিরাত কামনায় কোরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল হয়। ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে হয় বিশেষ প্রার্থনা সভা। দেশের সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও ছিল একই ধরনের আয়োজন।
ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি বিকেলে ‘৭১-এর গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং গণহত্যার জন্য দায়ী পাকিস্তানি হাইকমান্ডসহ সকল সংগঠনের বিচার’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারের আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আ ক ম মোজাম্মেল হক। সভাপতিত্ব করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির।
একই দিন জাতীয় জাদুঘরের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মিলনায়তনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত গণহত্যা দিবসের আলোচনা সভায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলছে বলে জানান। তিনি বলেন, একাত্তরের গণহত্যার বিষয়টি প্রথমে কূটনৈতিকভাবে সারাবিশ্বের মানুষের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে, যাতে ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব করা হলে কেউ আপত্তি জানিয়ে সেটি বাতিল করতে না পারে।
২৫ মার্চের কালরাতে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস গণহত্যাকে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন। সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে শহীদদের স্মরণে মোমবাতি প্রজ্বালন অনুষ্ঠানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে অ্যালামনাই নেতারা এ দাবি জানান। অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ. কে. আজাদ ও মহাসচিব রঞ্জন কর্মকারের নেতৃত্বে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম আফজালুর রহমান বাবু, প্রচার ও যোগাযোগ সম্পাদক কাজী মোয়াজ্জেম হোসেন, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য নাসির উদ্দিন মাহমুদ নান্টু, শেখ সালাহউদ্দিন আহমেদ, খুকু খালেদ, মাহমুদা সুলতানা হেলেন, সম্মানিত সদস্য সবিতা সাহা, উদয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ জোহরা খাতুন প্রমুখ।
পরে এ. কে. আজাদ বলেন, ২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক-ছাত্র-কর্মচারীকে নির্বিচারে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তিনি এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার প্রতি নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, ২৫ মার্চের এই গণহত্যাকে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি দিতে হবে।
রঞ্জন কর্মকার বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা চাই এই গণহত্যা আস্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাক। এ সময় তিনি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনারা প্রতিটা দেশের মানুষকে এই বিষয়টি তুলে ধরে তাদের সংগঠিত করে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করুন।
গণহত্যা দিবসে জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটি ভোর ৬টায় দলীয় কার্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন এবং জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখে। সকাল ৯টায় মিরপুর বি ব্লকে জল্লাদখানা বধ্যভূমি এবং সকাল ১১টায় রায়েরবাজার বধ্যভূমি ও জগন্নাথ হল বধ্যভূমিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে জাসদ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কেন্দ্রীয় নেতারা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ ছাড়া সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শহীদ কর্নেল তাহের মিলনায়তনে শহীদদের স্মরণে নির্মিত অস্থায়ী বেদিতে আলোক প্রজ্বালন এবং সন্ধ্যা ৭টায় জাসদ কার্যালয়ের সামনে আলোর মিছিল বের হয়।
গণহত্যা দিবস স্মরণে এবং সুনামগঞ্জের শাল্লায় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলার বিচারের দাবিতে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের উদ্যোগে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণে, জাতীয় টেনিস কমপ্লেক্স এবং শাহবাগে আলোর পদযাত্রা ও আলোচনা সভা হয়। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তব্য দেন সংগঠনের প্রেসিডিয়াম সদস্য পঙ্কজ ভট্টাচার্য (ভার্চুয়াল), ড. নূর মোহাম্মদ তালুকদার, অধ্যাপক এম এম আকাশ (ভার্চুয়াল), ঐক্য ন্যাপ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হারুনার রশিদ ভূঁইয়া, সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহিরুল ইসলাম জহির, কাজী সালমা সুলতানা প্রমুখ।
বিকেলে রাজধানীর তথ্য ভবনে গণহত্যা দিবস উপলক্ষে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর (ডিএফপি) আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. মুরাদ হাসান। গণহত্যা দিবস উপলক্ষে পিরোজপুর জেলা প্রশাসন আয়োজিত আলোচনা সভায় রাজধানীর বেইলি রোডের সরকারি বাসভবন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।