ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) অস্ত্র বাদে অন্য সব পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ শুল্ক্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশ সুবিধা পাচ্ছে। ২০২৪ সালে এই সুবিধা শেষ হবে। এর পরেও এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) সুবিধা অব্যাহত থাকবে কিনা তা নির্ভর করছে ইইউর বিবেচনায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র, সুশাসন ও আইনের শাসন পরিস্থিতি সন্তোষজনক কিনা তার ওপর। ইতোমধ্যে ইইউ এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছে।
আগামী ১৮ থেকে ২০ মে ইইউ-বাংলাদেশ যৌথ কমিশনের ১০ম সভা অনুষ্ঠিত হবে। ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিতব্য সভার জন্য ইইউ যেসব বিষয়ে আলোচনার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে গণতন্ত্র, সুশাসন ও আইনের শাসন। এই যৌথ কমিশনের সভার সঙ্গে এই কমিশনের বিশেষায়িত বিশেষ তিনটি সাব গ্রুপের সভাও অনুষ্ঠিত হবে। ওই সভার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন আলোচনার যে এজেন্ডা তৈরি করে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে, তা থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের এজেন্ডায় আলোচনার জন্য বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কার, আইনের শাসন, বিচার বিভাগের সংস্কার ও সুশাসন, আইনের প্রয়োগ ও মানবাধিকার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, জোটবদ্ধ হওয়ার স্বাধীনতা এবং সামাজিক সংগঠনের কার্যক্রম নিয়ে আলোচনার কথা বলা হয়েছে এজেন্ডাতে। এ ছাড়া সংখ্যালঘুদের অধিকার, নারী, শিশু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার, শ্রম অধিকার, জিএসপি প্লাস প্রস্তুতি, রোহিঙ্গা শরনার্থী সংকট ও পুনর্বাসন এবং অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হবে।
এসব বিষয়ে বাংলাদেশের নীতি ও অবস্থানপত্র তৈরি করতে ইতোমধ্যে প্রস্তুতিমূলক বৈঠক করেছে আইন ও বিচার বিভাগ। এই বিভাগের সংশ্নিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়নে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে আইন পাস করা হয়েছে। মানবাধিকার রক্ষায় সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ছাড়া সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষায়ও একাধিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। অনিয়ম, দুর্নীতি রোধে স্বাধীনভাবে কাজ করছে দুদক। এ ছাড়া শ্রম অধিকার রক্ষায় ২০১৩ সালে রানা পল্গাজা ধসের পর নানান ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের এসব কর্মকাণ্ডে তথ্য-প্রমাণসহ ওই বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে।
সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত ইউএস-বাংলাদেশ পার্টনারশিপ ডায়ালগেও বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার সুরক্ষা, র্যাব ও সংস্থাটির সাবেক ও বর্তমান কিছু কর্মকর্তার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাসহ শ্রমিক অধিকার, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমাদের পক্ষে বাংলাদেশের সমর্থনের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০১ সালের সহযোগিতা চুক্তির অধীনে ইইউ-বাংলাদেশ যৌথ কমিশন গঠিত হয়েছে। এর সর্বশেষ বা নবম বৈঠক ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৬০ ভাগ আসে ইইউভুক্ত দেশগুলো থেকে। ইইউ ২০২৪ সাল থেকে নতুন জিএসপি পলিসি চালু করতে যাচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পণ্যের শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। নতুন পলিসির আওতায় বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা অব্যাহত রাখতে ৯ দফা অ্যাকশন পল্গ্যান দিয়ে তা বাস্তবায়নের সময়সীমাভিত্তিক পথনকশা চেয়েছিল ইইউ। তাতে বাংলাদেশের জন্য প্রথমবারের মতো মানবাধিকার ইস্যু সম্পৃক্ত করা হয়েছে। শিশুশ্রম নিরসনসহ সবার জন্য মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং ইপিজেডভুক্ত কারখানাগুলোতে ট্রেড ইউনিয়ন চালুর মতো ‘স্পর্শকাতর’ বিষয়গুলোও রয়েছে।
এসব অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নে বাংলাদেশ ২০২৬ সাল পর্যন্ত মেয়াদি একটি রোডম্যাপ ইইউতে পাঠিয়েছে। ওই রোডম্যাপের বাস্তবায়ন পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখতে গত মাসে বাংলাদেশ ভিজিট করেছে ইইউর ইবিএ রিভিউ কমিটি। ২০২৪ সাল থেকে ইবিএ সুবিধা অব্যাহত রাখা ও উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর ২০২৯ সাল থেকে ইইউভুক্ত দেশগুলোতে জিএসপি সুবিধা পাওয়ার জন্য কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক তৎপরতা শুরু করেছে বাংলাদেশ।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারের জিএসপি সুবিধা স্থগিত করলেও ইবিএ বা জিএসপি সুবিধার সঙ্গে ইইউ এর আগে কখনও বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়টি সম্পৃক্ত করেনি। গত দু’বছর ধরে ইইউ বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে। একই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র গুরুত্ব দেওয়ায় এবার ইইউ বাড়তি গুরুত্ব দেবে বলে মনে করা হচ্ছে। তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইইউও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে বাংলাদেশের নিরপেক্ষ অবস্থান বদল করে পশ্চিমাদের পক্ষে সমর্থন চাইতে পারে।