রোববার একাদশ জাতীয় সংসদের ষোড়শ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও উন্নয়নের মতো মৌলিক প্রশ্নে দল-মত ও শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে আপামর জনগণকে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস এবং তাদের সব প্রত্যাশার কেন্দ্রবিন্দু জাতীয় সংসদ। জনপ্রতিনিধি হিসেবে জনস্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হবে। আমি সরকারি দল ও বিরোধী দলের সব সংসদ সদস্যকে এ মহান জাতীয় সংসদে যথাযথ ও কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানাই। নতুন প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, সুখী, সুন্দর, উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ উপহার দেওয়া আমাদের পবিত্র কর্তব্য। এ লক্ষ্যে গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও উন্নয়নের মতো মৌলিক প্রশ্নে দল-মত ও শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে আপামর জনগণকে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আমি উদাত্ত আহ্বান জানাই।
রাষ্ট্রপতি বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবিসংবাদিত নেতৃত্বে বাঙালি অর্জন করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য তার অব্যাহত সংগ্রাম, নির্ভীক ও দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং গভীর দেশপ্রেম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বীকৃত। জাতির পিতার আদর্শকে ধারণ করে তারই যোগ্য উত্তরসূরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নেতৃত্বে আজ বাঙালি জাতি এগিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর আজীবন লালিত স্বপ্ন সুখী ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়ার পথে। আসুন লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত গৌরবোজ্জ্বল মহান স্বাধীনতা সমুন্নত রেখে দেশ থেকে সন্ত্রাস, মাদক, দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদ নির্মূলের মাধ্যমে জাতির পিতার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়তে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করি।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর নীতির কারণে দেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিরাজ করছে যা উন্নয়নের পূর্ব শর্ত। বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে বিশ্বের জন্য একটি অনন্য উদাহরণ। দেশের সব সম্প্রদায়ের মানুষ যাতে সম্প্রীতি সহকারে স্ব-স্ব ধর্মের চর্চা করতে পারে সে বিষয়ে সরকার সচেষ্ট রয়েছে। মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানসহ সব সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবসমূহ নির্বিঘ্নে যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য ও উৎসবমুখর পরিবেশে শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপন করা হচ্ছে। তথাপি ধর্মের নামে কোনো ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী যাতে দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে না পারে সেদিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রাজ্ঞা ও দূরদর্শী নেতৃত্বে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ মাছ, মাংস ও ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ছয় লক্ষ ৭৯ হাজারের অধিক মৎস্যচাষী, খামারি ও উদ্যোক্তাকে প্রায় ৮১৯ কোটি টাকা নগদ আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। মুজিববর্ষ উপলক্ষে কার্প জাতীয় মাছের বৃহত্তম প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীকে ‘বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ’ ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি মানব উন্নয়নে বাংলাদেশের প্রভূত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, ‘মুজিববর্ষে দেশের একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না’— মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় এক লক্ষ ৪৮ হাজার ৩৯৭ ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে দুই শতক সরকারি খাস জমি বন্দোবস্ত প্রদানপূর্বক দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সেমি-পাকা গৃহ নির্মাণ করে বিনামূল্যে উপকারভোগী স্বামী-স্ত্রীকে এর যৌথ মালিকানা প্রদান করা হয়েছে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশাল একটি জনগোষ্ঠীকে পুনর্বাসন বিশ্বে সর্ববৃহৎ ও সর্বপ্রথম। দেশের ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল ও অসহায় মানুষের দারিদ্র্য বিমোচনের ধারণা মানবিকতার নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। প্রধানমন্ত্রীর এ ধারণা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে শেখ হাসিনা মডেল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এজন্য আমি প্রধানমন্ত্রীকে আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, সরকার অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে বিশ্বাসী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে স্বাক্ষরিত ‘শান্তি চুক্তির’ ফলে অনগ্রসর পার্বত্য অঞ্চল মূল জাতীয় উন্নয়নে যুক্ত হওয়ায় জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বিরাজ করছে। সরকারের অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ কর্মসূচির আওতায় প্রতিটি গ্রামে শহরের সুবিধাদি এবং প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগরী ও পার্শ্ববর্তী এলাকার যানজট নিরসন এবং পরিবেশ উন্নয়নে ছয়টি এমআরটি লাইন নির্মাণের লক্ষ্যে সরকার সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা- ২০৩০ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে এমআরটি লাইন ছয়-এর নির্মাণকাজ ৭৪ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে এবং ১০ সেট মেট্রো ট্রেন বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশে প্রথম মেট্রোরেল চলাচল শুরু করবে, ইনশাআল্লাহ।
রাষ্ট্রপতি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৫ দশমিক চার শতাংশ লোকের কমপক্ষে একটি মোবাইল ফোনের মালিকানা রয়েছে এবং ১৫ বছরের অধিক বয়সী মোট ৪৩ দশমিক পাঁচ শতাংশ ব্যক্তি ইণ্টারনেট ব্যবহার করেন। বিশ্বের নবম দেশ হিসাবে ১২ ডিসেম্বর ২০২১ থেকে বাংলাদেশ ফাইভ জি নেটওয়ার্ক যুগে প্রবেশ করেছে। ফাইভ জি সহজলভ্যতার কারণে প্রচলিত অনলাইনভিত্তিক সব কার্যক্রম আরও দক্ষ ও গতিশীল হবে। স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের জন্য এটি একটি বিশাল অর্জন।
তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’— এ নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা সরকারের করোনা মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছে। মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলন, প্রতিবেশী দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের রাষ্ট্রীয় সফর এবং বিদেশে নানাবিধ অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক-সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে। এর ফলে করোনা পরিস্থিতিতেও একাধিক সমঝোতা স্মারক, অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ দলিলসমূহ স্বাক্ষরিত হয়েছে।
মো. আবদুল হামিদ বলেন, সদ্য সমাপ্ত বিশ্ব শান্তি সম্মেলন সফল আয়োজনের মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের আন্তরিকতা পৃথিবীব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। এ সম্মেলনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বজনীন টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গড়ে তোলার উপর গুরুত্বারোপ করেন।
ন্যায়বিচার প্রাপ্তি প্রতিটি নাগরিকের অধিকার। বিচারাধীন ফৌজদারি মামলা দ্রুততম সময়ে নিষ্পত্তির লক্ষ্যে মোবাইল ফোনে এসএমএস প্রেরণের মাধ্যমে সাক্ষীদের প্রতি সমন জারির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদক্ষ নির্দেশনায় ভূমিসেবা এখন মানুষের হাতের মুঠোয়।
তিনি বলেন, অনলাইন ভূমি-উন্নয়ন কর, ই-নামজারি, ডিজিটাল রেকর্ড রুম, হটলাইন-সেবা, ই রেজিস্ট্রেশন-মিউটেশন সংযোগ, সায়রাত ও অধিগ্রহণকৃত জমির ডেটাবেজ, রাজস্ব আদালতে অনলাইন শুনানি, সিভিল স্যুট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম এবং এনআইডি ভেরিফিকেশন ভূমিসেবায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করেছে। ভূমি সংক্রান্ত সেবা সহজিকরণের জন্য স্ব-স্ব প্রশাসনিক এখতিয়ার বজায় রেখে উপজেলা ভূমি অফিসের সঙ্গে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের আন্তঃসংযোগ স্থাপন প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন। এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে ভূমি নিবন্ধন ব্যবস্থাপনা ডিজিটাইজেশনের জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, পরিবেশ সুরক্ষা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা আজ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বিস্তৃত হয়েছে। জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন কপ-২৬-এ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের দৃঢ় অবস্থান ও ভূমিকা বিশ্বে আমাদের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি করেছে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের পাশাপাশি গ্রামীণ জনপদে আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে সামাজিক বনায়ন এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। বিভিন্ন দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য ৬৬ হাজার ২৯১টি দুর্যোগ-সহনীয় বাসগৃহ এবং উপকূলীয় ১৬টি জেলায় ২২০টি বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। বজ্রপাতে মৃত্যুরোধে আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম স্থাপন এবং কংক্রিটের বজ্রপাত-নিরোধক শেল্টার নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, রূপকল্প ২০২১-এর সফল বাস্তবায়ন শেষে রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়িত হচ্ছে। পানি ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশগত পরিবর্তন বিবেচনা করে প্রণীত বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-এর আওতায় বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ২০৩১ সালে উচ্চ-মধ্য আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হতে চাই আমরা। ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে বাংলাদেশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে উত্তরণ পরবর্তী দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে তা দ্রুত বাস্তবায়নের কাজ শুরু করতে হবে। উন্নত বাংলাদেশ গড়তে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুযোগ কাজে লাগাতে হলে আমাদের জনমিতির সুবিধা পুরোপুরি ব্যবহার করতে হবে। এজন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে যাতে আমাদের নতুন প্রজন্ম দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে।
মো. আবদুল হামিদ বলেন, নতুন নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধানসহ বিদেশে শ্রমশক্তি রফতানির প্রচেষ্টা আরও জোরদার করতে হবে। বিশ্ববাজারের চাহিদা অনুযায়ী নতুন প্রশিক্ষণ কারিক্যুলাম প্রস্তুত, বিদ্যমান কারিক্যুলাম যুগোপযোগীকরণ এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে সার্টিফায়েড দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে। বিগত দেড় দশকে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এজন্য সরকারি অর্থের অপব্যবহার রোধপূর্বক প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি সরকারি সব কার্যক্রমে জনগণের যথাযথ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিমূলক সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে গণতন্ত্রকে অধিক কার্যকর করতে হবে।