নজরুল মিয়া, মৌলভীবাজার পৌর শহরের রিকশাচালক। মেসে থাকেন তিনি। দুইবেলা খাবারের খরচ পড়ে ১শ থেকে ১শ ১০ টাকা। সঙ্গে ঘরভাড়া ও রিকশার জমা দিতে হয় দিনপ্রতি ১শ ৭০ টাকা। মাস শেষে দেশের বাড়িতে কিছু টাকা পাঠাতে হয় তাকে।
তিনি বলেন, ‘মাঝে মাঝে শুধু একবেলা খাই, টাকা বাঁচাতে।’
নজরুল মিয়ার মতো মৌলভীবাজার পৌর শহরে বসবাসকারী শ্রমজীবী মানুষের এখন এমন বেহাল দশা। জিনিসপত্রের বাড়তি দামে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। খরচ বাড়ায় দুপুরের না খাওয়াই এখন নিয়মে দাঁড়িয়েছে এদের। প্রতিটি খাবার পণ্যের খরচ বাড়ায় দুপুর বেলার খাবারের প্রতি আগ্রহ নেই তাদের।
মঙ্গলবার (১৪ মার্চ) মৌলভীবাজার শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে শ্রমজীবী মানুষদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।
নজরুল মিয়া ঢাকা মেইলের প্রতিবেদককে আরও বলেন, ‘আগে মেসে দুপুরে গিয়ে ভাত খেতাম। এখন কোনো ছোট দোকানে ১৫ থেকে ২০ টাকায় চায়ের সঙ্গে বিস্কুট খাই।’
কথা প্রসঙ্গে আরেক দিনমজুর সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার দেশের বাড়ি হবিগঞ্জ। সেখানে মা, ভাই থাকেন। এখানে এসেছি ছয় মাস হলো। মাসে ১২ থেকে ১৫ দিন কাজ পাই। এখন মেসে থাকা খাওয়ার খরচ বেড়ে গেছে। তাই কাজ না থাকলে একবেলা মেসে খাই। আগের মত গ্রামের বাড়ীতে টাকা পাঠাতে পারি না। তাই কষ্ট করেই দিন চালাতে হয়।’
বেশ কয়েক দিন ধরে দুপুরবেলা ভাত খাওয়া হয়নি জানিয়ে রিকশাচালক হামিদ ভূইয়া বলেন, ‘আগে দুপুরবেলায় ৩০ টাকায় ডাল, সবজি কিংবা ডিম দিয়ে ভাত খেতাম। এখন সেই খাবার খেতে হলে ৫০ থেকে টাকা লাগছে।’
সেন্ট্রাল রোডে কথা হয় ভ্রাম্যমাণ ফল বিক্রেতা আক্তার হোসেন সঙ্গে। থাকেন জেলার শমশেরনগর উপজেলায়। প্রতিদিনই আসেন জেলা শহরে ফল বিক্রি করতে। তিনি ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সকালে বাড়ি থেকে খেয়ে আসি, দুপুরবেলায় না খাওয়াই এখন নিয়মে দাঁড়িয়েছে। রুজি-রোজগার এখন তেমনটা হয় না, তাই সন্ধ্যায় বাড়ি গিয়েই খাই।’
একটি বেসরকারি প্রতিষ্টানের প্রহরী আবুল হাসান বলেন, ‘আগে তো সংসারের খরচ চালিয়ে কিছু টাকা সঞ্চয় করতে পারতাম। কিন্তু গত দুই মাস হল ধারদেনা করে সংসার চলছে। আমার মতো মানুষদের অবস্থা খুবই খারাপ, টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে গেছে।’
পশ্চিমবাজার এলাকার একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করেন আজগর মিয়া। তিনি বলেন, ‘সবকিছুর দাম তো বাড়ছে, আমাদের বেতন তো বাড়ে না। কিভাবে খাবো আর কিভাবে চলবো সেটা নিয়ে চিন্তায় আছি। যে বেতন পাই তাতে দুপুরে পেটভরা খাবার খরচ জোগাতে কষ্ট হয়।’
শহরের টিসি মার্কেট এলাকার দীলিপ বাবুর মেসে দুই তিন মাস পূর্বে দুপুরবেলায় ৬০ থেকে ৭০ জনের রান্না হতো, এখন ২৫ থেকে ৩০ জনের রান্না হয়।
দিন দিন খাবার খেতে আসা কাস্টমারের সংখ্যা কমছে জানিয়ে মেস মালিক দীলিপ দেব ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আগে জনপ্রতি ৫০ টাকা মিল ছিল, এখন প্রতিটা জিনিসের দাম বাড়ায় বাধ্যহয়ে জনপ্রতি ৬০ টাকা মিল করতে হয়েছে।’
চাঁদনীঘাট এলাকার একটি খাবার হোটেলের ম্যানেজার জসিম মিয়া বলেন, ‘প্রতিটা পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে হোটেলে তৈরি পণ্যের দাম বেড়েছে। এতে কাস্টমার হারাচ্ছি।’
বাজার ঘুরে দেখা যায়, গত সপ্তাহের তুলনায় প্রায় সবকটি সবজি আগের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিকেজি কাঁচা মরিচ ১২০ টাকা, শসা ৫০ টাকা, টমেটো ৩০ টাকা, বাঁধাকপি ২৫ টাকা, ফুলকপি ৪০ টাকা, গাজর ৪৫ টাকা, গোল বেগুন ৬০ থেকে ৬৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। লেবু প্রতিহালি ৪০ থেকে ৮০ টাকা ও লাউ প্রতি পিস ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৯০ টাকা, পামওয়েল ১৪০ টাকা, সরিষার তেল ৩৬০ টাকা ও প্রতিকেজি চিনি ১১৫ টাকা, মুসুরি ডাল ১০০ থেকে ১৫০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। আটা ও ময়দাতে কেজিপ্রতি ৮ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। প্রতিকেজি পেঁয়াজ ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ২৫ কেজির প্রতি বস্তা চালে ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা বেড়েছে।
অপরদিকে, মাছের দামও বেড়েছে হুহু করে। সব ছোট মাছ কেজিতে বেড়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা করে। আর বড়মাছ কেজিতে বেড়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। ফার্মের মোরগ ২৩০ থেকে ২৩৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
মৌলভীবাজার সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক জহরলাল দত্ত বলেন, ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রতিটা দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ মানুষ খুব অসহায় হয়ে পড়েছেন। অস্বাভাবিকভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধির কারণে এখন অনেক শ্রমজীবী মানুষজনও দুপুরবেলার খাবার কমিয়ে দিয়েছেন।’
বাজার তদারকি চলছে। কেউ যাতে দাম অতিরিক্ত বাড়াতে না পরে সেদিকে নজরদারি আছে বলে জানায়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মৌলভীবাজার জেলা কার্যালয়।