ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। পড়ছেন স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে। ছেলেবেলায় মা-বাবাকে হারিয়েছেন। আত্মীয়-স্বজনের সহযোগিতায় লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এখন আর চলছে না। আগে সাড়ে তিন হাজার টাকায় টেনেটুনে মাস চালাতেন তিনি। এখন অন্তত দেড় হাজার টাকা বেশি লাগছে তার।
জাহিদুল জানান, অর্থের সংস্থান করতে না পেরে তিনি সকালের নাশতা খাওয়া বাদ দিয়েছেন। বিকেল বা সন্ধ্যায়ও কিছু খান না। কেবল দুপুর আর রাতে হলের ক্যান্টিনে ভাত খান। সেখানেও মিতব্যয়ী হতে হয়েছে তাকে। বেশিরভাগ সময় কেবল সবজি দিয়েই দুপুরের খাবার সারছেন তিনি; মাছ-মাংস খাওয়া একরকম বাদ দিয়েছেন।
দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ক্যান্টিন ও ক্যাম্পাসের খাবারের দোকানগুলোতে। যার ফলে শুধু জাহিদ নন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী এখন সংকটে পড়েছেন।
মুরগির মাংস যেখানে ৩৫-৪০ টাকায় পাওয়া যেত, সেখানে এখন তা ৫০ টাকা করা হয়েছে। ৩০-৩৫ টাকার মাছের পিস এখন নেওয়া হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা। গরুর মাংস ৪৫-৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০-৬৫ টাকা। ডিম-ভাত পাওয়া যেত ২৫-৩০ টাকায় এখন সেটি ৩৫-৪০ টাকা। এছাড়া অনেক খাবারেই তুলনামূলক দাম বেশি রাখতে দেখা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ক্যান্টিন ও ক্যাফেটেরিয়া এবং ক্যাম্পাসের খাবারের দোকানগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশিরভাগ হলে খাবারের দাম বেড়ে গেছে। যেখানে বাড়েনি, সেখানে অন্য উপায় অবলম্বন করা হয়েছে। যেমন, মাছ ও মাংসের আকার ছোট হয়ে গেছে। কমে গেছে সবজি-ভর্তার পরিমাণ।
কয়েকটি হল ঘুরে দেখা যায়- মুরগির মাংস যেখানে ৩৫-৪০ টাকায় পাওয়া যেত, সেখানে এখন তা ৫০ টাকা করা হয়েছে। ৩০-৩৫ টাকার মাছের পিস এখন নেওয়া হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা। গরুর মাংস ৪৫-৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০-৬৫ টাকা। ডিম-ভাত পাওয়া যেত ২৫-৩০ টাকায় এখন সেটি ৩৫-৪০ টাকা। এছাড়া অনেক খাবারেই তুলনামূলক দাম বেশি রাখতে দেখা গেছে।
এক মাসের খরচ চালাতে আগের চেয়ে ১ হাজার থেকে ১৫০০ টাকা বেশি লাগছে। টিউশনির টাকা কিন্তু বাড়েনি। মাস শেষে দেখা যায় ‘শ্রীলঙ্কা’ হয়ে বসে আছি! কী করব, বাধ্য হয়ে খাওয়া-দাওয়া সীমিত করতে হচ্ছেকবি সুফিয়া কামাল হলের শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার
ক্যান্টিনের চেয়ে কিছুটা ভালো মানের খাবারের আশায় অনেক শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস ও হলের খাবারের দোকানগুলোতে খান। সেখানেও খাবারের দাম বেড়েছে আগের তুলনায়। দোকান ভেদে মুরগির মাংস ৬০-৬৫ টাকা, খিচুড়ি ৬০-৭০ টাকা, পোলাও ৭০-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আগে ৫০-৬০ টাকার মধ্যে এসব খাবার পাওয়া যেত।
এছাড়া দোকানগুলোতে কলা-রুটি থেকে শুরু করে সব ধরনের নাশতা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দামও বেড়েছে।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বাস্তবতা মানছেন শিক্ষার্থীরাও। তারা বলছেন, হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে যদি কিছুটা ভর্তুকি দেওয়া হয় আর কর্তৃপক্ষ যদি ক্যান্টিনগুলো মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করেন তাহলে কম খরচের মধ্যেই মোটামুটি একটা মানের খাবার খেতে পারবেন শিক্ষার্থীরা।
শামসুন্নাহার হলের শিক্ষার্থী তামান্না আক্তার বলেন, হলে ডাইনিং ক্যান্টিনে দফায় দফায় দাম বৃদ্ধি করলেও খাবারের মানের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তিনবেলা খাবারের যোগান দিতে আগের চেয়ে দেড়গুণ টাকা গুনতে হচ্ছে। বিপরীতে খাবারের মান কমে গেছে। পরিমাণ যতটুকু দেয় এতে একজন মানুষের দৈনিক যে ন্যূনতম ক্যালরি প্রয়োজন, সেটাও পূরণ হয় না। খাদ্যের মূল্য তালিকায় কেন্দ্রীয় প্রশাসনের হস্তক্ষেপ এবং মনিটরিং সেল গঠন করা দরকার।
কবি সুফিয়া কামাল হলের শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার বলেন, এক মাসের খরচ চালাতে আগের চেয়ে ১ হাজার থেকে ১৫০০ টাকা বেশি লাগছে। টিউশনির টাকা কিন্তু বাড়েনি। মাস শেষে দেখা যায় ‘শ্রীলঙ্কা’ হয়ে বসে আছি! কী করব, বাধ্য হয়ে খাওয়া-দাওয়া সীমিত করতে হচ্ছে।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের শিক্ষার্থী সাব্বির আহমেদ বলেন, হলের ক্যান্টিনের খাবারের মান ভালো নয়, দামও তুলনামূলক বেশি। খাবারের মধ্যে পোকা বের হয়, পচা-বাসি খাবার পরিবেশন করা হয়। এসব দিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো নজরদারি নেই। এখন ভর্তুকি দিয়ে হলেও ক্যান্টিনের খাবারের মান বাড়ানো দরকার।
ক্যান্টিন মালিকরা বলছেন, এই দামে এর চেয়ে ভালো মানের খাবার দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তাদের নিজেদেরও সমস্যা হচ্ছে। খাবারের দাম বৃদ্ধি করা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ভর্তুকি চালু করার দাবি তাদের। এছাড়া রাজনৈতিক পরিচয়ে বিনা টাকায় খাওয়া (ফাও খাওয়া) বন্ধ করতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তারা।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ক্যান্টিন মালিক ডালিম হোসেন বলেন, আমাদের পক্ষে এভাবে চালানো সম্ভব হচ্ছে না। দাম বাড়াতেও দিচ্ছে না। শুধু মাছ-মুরগীর পিস হালকা ছোট করেছি, আর ডিমে ৫ টাকা বৃদ্ধি করেছি। তেলের মূল্য হয়ে গেছে ডাবল, চালের বস্তার দাম বেড়েছে ৫০০ টাকা, ডিমের দাম বেড়েছে, এভাবে সবকিছুর দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের ভর্তুকি দিতে হবে, না হয় খাবারের দাম বাড়াতে হবে। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ক্যান্টিন মালিক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আগে আমাদের ভর্তুকি দেওয়া হতো, এখন দেওয়া হয় না। সবকিছুর দাম এত বেড়েছে যে আমাদের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। হল প্রশাসনকে আমরা বিষয়টা জানাব। যদি সমন্বয় করা না হয় তাহলে ক্যান্টিন বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি হলের ক্যান্টিন মালিক বলেন, প্রতিদিন ২ হাজার টাকা করে মাসে প্রায় ৬০ হাজার টাকা কেবল ‘ফাও’ খেয়ে যান রাজনৈতিক পরিচয়ধারী শিক্ষার্থীরা। তাদের কিছু বলতেও পারি না। বর্তমান পরিস্থিতিতে যেখানে এমনিতেই চলতে পারছি না, সেখানে যদি ফাও খায়, আমাদের লাভ কীভাবে হবে? আমি যদি প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানাই তাহলে কালই আমাকে এখান থেকে বের করে দেবে তারা।
ডাকসুর সর্বশেষ ভিপি নুরুল হক নুর এ বিষয়ে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিৎ এখন ভর্তুকি দিয়ে হলেও সবকিছু সহনীয় পর্যায়ে রাখা। শিক্ষার্থীরা যাতে বিপদে পড়ে না যায়। একইসঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ফাও খাওয়াও বন্ধ করতে হবে। তাদের ফাও খাওয়ার কারণে খাবারের দাম বেড়ে যায়, মান কমে যায়। এক্ষেত্রে হল প্রশাসনের শক্ত ভূমিকা রাখা উচিত। তাহলেই সবকিছু সহনীয় পর্যায়ে থাকবে।
খাবারের নিম্ন মানের জন্য প্রশাসন ও ক্যান্টিন মালিকরা দায়ী উল্লেখ করে ডাকসুর সাবেক এজিএস এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, আমাদের হলগুলোতে যে মান দেওয়া হয় সেটা আসলে মানসম্মত নয় এবং যেরকম পুষ্টিকর উপাদান থাকা প্রয়োজন সেটা নেই। এর দায় আমাদের বিশ্বিবদ্যালয় প্রশাসন এবং ক্যান্টিন মালিকদের নিতে হবে। শিক্ষার্থীরা যেন ন্যায্য মূল্যে খাবার পায় সে ব্যবস্থা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। ভর্তুকি প্রদান করে কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে বলে আমি মনে করি।
হল প্রশাসন বলছে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে সবারই একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে এ সংকট সাময়িক। দ্রুত সময়ের মধ্যে এ চিত্রে পরিবর্তন আসবে বলে প্রত্যাশা তাদের।
শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. আব্দুর রহিম বলেন, ক্যান্টিন মালিকদের বেশি সমস্যা হচ্ছে বলে আমি মনে করি না। ভর্তুকি না দিলেও অনেক কিছুতে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ছাড় দেয়। তাদেরও শিক্ষার্থীদের ছাড় দেওয়া উচিত। দাম সহনশীল রেখে ভালো মানের খাবার পরিবেশন করা উচিত। এই সংকট সাময়িক, আশা করি দ্রুত সংকট কেটে যাবে। কয়েকটা দিন আমরা দেখি, তারপরও যদি সংকট না কাটে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। আর ফাও খাওয়ার বিষয়টা খুবই নিন্দনীয়, এর নিরসন দরকার।
শামসুন্নাহার হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. লাফিফা জামাল বলেন, দ্রব্যমূল্য এত বেশি বেড়েছে যে তার সাথে তাল মিলিয়ে চলা কঠিন হয়ে পড়েছে। সঙ্গত কারণেই হলগুলোতে খাবারের দাম কম বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের হলেও একটু একটু দাম বেড়েছে। তবে খাবারের মানে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। আমরা কিছু কিছু অভিযোগ পেয়েছি, তার প্রেক্ষিতে আমরা নতুন ক্যাটার নিয়োগের দরপত্র আহ্বান করেছি। পরিবর্তন এনে দেখা যাক কেমন হয়, তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির দিকটাও আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. আকরাম হোসাইন বলেন, তারা (ক্যানটিন মালিক) আমাদের কাছে এখনো কোনো আবেদন জানায়নি। আবেদন জানালে তখন আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করব।
আলোচনার মাধ্যমে খাবারের দাম সবার জন্য সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসার কথা জানিয়েছেন প্রভোস্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ক্যান্টিন মালিক এবং আমাদের শিক্ষার্থীরা উভয়েই খুব অস্বস্তির মধ্যে আছেন। বর্তমানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এর জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। আমরা দুয়েক দিনের মধ্যে সভা ডেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অনুরোধ করব এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য।
ভর্তুকির বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় তো সরকারি বাজেটে চলে। যে বাস্তবতা সেটি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। আমরা যতটুকু পারি বাড়তি সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করি। আমরা ক্যান্টিন মালিকদের বলব, পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হয়ে আসছে, সকলকে দায়িত্বশীল ও সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে হবে। কেউ যেন বাড়তি দাম না নেয়, শিক্ষার্থীদের উপর যেন চাপ না পড়ে।