পুলিশ হেফাজতে মাহসা আমিনি নামে ২২ বছর বয়সী এক তরুণীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে ইরান। দেশজুড়ে গড়ে ওঠা এই বিক্ষোভ প্রতিবাদ দেশটিকে বহু বছরের মধ্যে এবার মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।
ওই তরুণীর বিরুদ্ধে হিজাব সম্পর্কিত নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগ তুলেছিলো পুলিশ। তবে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তার মৃত্যু হয়েছে স্বাস্থ্যগত কারণে। যদিও ওই তরুণীর পরিবার ও বহু ইরানি নাগরিকের বিশ্বাস, পুলিশ হেফাজতে মারধরের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে।
বিক্ষোভকারীরা বলছেন, তারা যদি এখনই এর বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ান তাহলে একদিন তাদেরও একই ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে। ইরানের বিভিন্ন স্থানে চলমান এই বিক্ষোভে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
এই ঘটনা এমন সময় ঘটলো যখন ইরানের মানুষ এমনিতেই ক্ষুব্ধ। এলিট রাজনীতিকদের দুর্নীতি, ৫০ শতাংশের বেশি মুদ্রাস্ফীতির কারণে দারিদ্র বেড়ে যাওয়া, পারমাণবিক আলোচনায় অচলাবস্থা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার অভাব দেশটির তরুণ সমাজসহ একটি বিরাট জনগোষ্ঠীকে হতাশ করে তুলেছে।
ইরানের সোশ্যাল সিকিউরিটি অর্গানাইজেশন রিসার্চ ইন্সটিটিউটের মতে, দেশটির অন্তত আড়াই কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করছে এবং ক্রমশ এই সংখ্যা বাড়ছে। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে এটাই বিক্ষোভের নতুন ঘটনা নয়। তবে অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, আগের যে কোনো ঘটনার তুলনায় এবারে বিক্ষোভে ভিন্নতা রয়েছে। সব কিছুর বাইরে এটা নারীদের প্রতিবাদ।
সমাজে পরিবর্তন এসেছে
নাগরিক অধিকার রক্ষা নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো অনেক দিন ধরেই ইরানের নারীদের ওপর দমন-পীড়নের বিষয়টি তুলে ধরছে। মূলত ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের সমাজে নারীরাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
বিপ্লবের পরপরই নারীদের হিজাব পড়তে বাধ্য করা হয় এবং তারা তাদের অনেক অধিকারও হারান। এর মধ্যে আছে ভ্রমণ এবং কাজের অধিকার।
ওই সময় এসব পরিবর্তনের বিষয়ে পুরুষদের দিক থেকে খুব একটা কথা শোনা যায়নি। এখন অনেক পুরুষকেও বিক্ষোভ-প্রতিবাদে অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, প্রগতিশীল দাবির প্রতি সমাজে পরিবর্তন এসেছে। সুইডেন ভিত্তিক ইরানি সমাজবিজ্ঞানী মেহরদাদ দারভিশপো এমন মন্তব্য করেছেন।
এবারের বিক্ষোভের প্রধান শ্লোগান হলো: ‘নারী, জীবন, মুক্তি’- যা মূলত ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান ও সমতার আহবান। এছাড়া এবারের বিক্ষোভ আগের চেয়ে অনেক বেশি অংশগ্রহণমূলক।
এর আগে ২০০৯ সালে কথিত গ্রিন মুভমেন্টের সময় নির্বাচনে কারচুপির প্রতিবাদে হওয়া আন্দোলনে মধ্যবিত্তরাই অংশ নিয়েছিলো। তখন বড় আন্দোলন হলেও সেটি বড় শহরগুলোতেই সীমাবদ্ধ ছিলো।
এছাড়া ২০১৭ ও ২০১৯ সালের আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিলো দরিদ্রদের মধ্যে। কিন্তু এবারের আন্দোলনে মধ্যবিত্ত ও শ্রমজীবী উভয় শ্রেণীর মানুষের অংশ নেওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। মেহরদাদ দারভিশপো বলেন, আমরা আসলে একটি মেগা আন্দোলনের জন্ম দেখছি। এ আন্দোলনটি নারীদের নেতৃত্বে হচ্ছে কিন্তু তারা অন্যদেরও আন্দোলনে সামিল করতে সমর্থ হচ্ছে।
সরকারের বিকল্প
কর্তৃপক্ষ একটি কঠিন পরিস্থিতিতে আছে। মাহসা আমিনির মৃত্যু সরকারের সমর্থকদের একটি অংশকেও বিপাকে ফেলে দিয়েছে। নারীদের বিরুদ্ধে নৈতিক পুলিশকে ব্যবহারের কৌশল নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে।
গাশ্ত-ই এরশাদ (আক্ষরিক অনুবাদ – নির্দেশ টহলদার) নামের এই বিশেষ পুলিশ বাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে লোকজন যেন ইসলামি আদর্শ ও নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় সেটা নিশ্চিত করা এবং কেউ ‘অনৈতিক’ পোশাক পরেছে মনে হলে তাকে আটক করার।
ইরানে প্রচলিত শরিয়া আইন অনুযায়ী নারীদের হিজাব পরা বা চাদর দিয়ে মাথা ঢাকা বাধ্যতামূলক। এছাড়াও নারীদের শরীর সম্পূর্ণ ঢেকে রাখতে পা পর্যন্ত লম্বা ও ঢিলা পোশাক পরার বিধান রয়েছে দেশটিতে।
সুতরাং এখন সরকারের হাতে দুটো বিকল্প আছে- একটি হলো হিজাব সম্পর্কিত নিয়ম কানুন পরিবর্তন করা। আবার এটি করলে তা অনেক বিক্ষোভকারীকে সরকার পরিবর্তনের দাবি আদায়ের দিকে উৎসাহিত করে তুলতে পারে। অথবা কোনো কিছুই পরিবর্তন না করা এবং সহিংস দমন বা বিক্ষোভকারীদের হত্যা করা। এগুলো সাময়িকভাবে পরিস্থিতিকে শান্ত করতে পারে কিন্তু সেটি আসলে কেবল ক্রমবর্ধমান ক্ষোভকেই উসকে দেবে।
পুলিশ বাহিনীর যেসব সদস্য এখন দমন-পীড়ন করছে তাদের অনেকেও চরম অর্থনৈতিক সংকটে আছে। চলমান বিক্ষোভ দীর্ঘায়িত হলে তারাও হয়তো অবস্থান পরিবর্তন করতে পারেন। আবার দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার বয়স এখন ৮৩ বছর। তার অসুস্থতার বিষয়টিও বহু ইরানি নাগরিকের চিন্তায় আছে। তার অবর্তমানে কে এই দায়িত্ব পাবেন এবং তিনি সরকারের কট্টর সমর্থকদের সমর্থন পাবেন কি না তা পরিষ্কার নয়। তাই এটাই হয়তো শেষ অধ্যায় নয় কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হয়ে উঠতে পারে।