মঙ্গলবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় সেগুনবাগিচাস্থ মহিলা পরিষদের আনোয়ারা বেগম-মুনিরা খান মিলনায়তনে “বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের ঘটনায় করণীয় বিষয়ে’’ নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির সম্মানিত সদস্যবৃন্দের সাথে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় অংশ নেওয়া বক্তারা এসব কথা বলেন।
মতবিনিময় সভায় সভাপতিত্ব করেন আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ, নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন, ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম।
বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের ঘটনা বিষয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম।
লিখিত বক্তব্যে মহিলা পরিষদ সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, প্রচারমূলক ও সচেতনতামূলক বিভিন্নমুখী উদ্যোগ ও আইন সংস্কার নেটওয়ার্কসহ বহুমুখী কর্মকাণ্ডের পরও নারী ও কন্যার প্রতি যৌন হয়রানি বন্ধে কার্যকরী ভূমিকা দৃশ্যমান হচ্ছে না। বিগত সময়েও নারী ও কন্যা নির্যাতনের ঘটনা উদ্বেগজনক। বিভিন্ন সময়ে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, গণ-পরিবহনে সংঘটিত যৌন হয়রানির মতো ঘৃণ্য অপরাধ দমনে কমিটির উদ্যোগে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অপরাধসমূহের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ, দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
নারী ও কন্যা নির্যাতন এবং সামাজিক অনাচার প্রতিরোধ জাতীয় কমিটি মনে করে সংগঠিত ঘটনার প্রতিবাদে একমাত্র শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন সমাজ ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে এই অপরাধ দমনে সহায়তা করতে পারে।
তিনি এসময় শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পথে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি নির্যাতনের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে ওঠার অভাব;বিভিন্ন জায়গায় অভিযোগ কমিটি গঠিত হওয়ার পরও প্রশাসনিক অসহযোগিতার কারণে কমিটিগুলির স্বাধীনভাবে কাজ বাধাগ্রস্ত; রাজনৈতিক দলসমূহ, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিবৃন্দ, সর্বোপরি সংসদের নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে যথেষ্ট উদ্যোগের অভাব; সমাজে দুর্নীতি, ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার, সুশাসনের অভাবের ফলে বিচার প্রক্রিয়ায় বিলম্ব; নারী বিরোধী প্রচারণা বৃদ্ধি, নারী-পুরুষের অংশীদারিত্বে সমতা না থাকা; সমাজে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার সীমিত সুযোগ, মাদকের বিস্তার, যুবসমাজের কর্মসংস্থানের সংকটের ফলে অপরাধ বৃদ্ধি, বিশেষ করে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি করছে; শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়নের জন্য যথাযথ এবং প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাব; উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন করে সম্পত্তিতে সমানাধিকার প্রদানের জন্য ইউনিফর্ম ফ্যামিলি কোড (ইউএফসি) চালু না হওয়া ইত্যাদি সীমাবদ্ধতাকে দূর করার আহ্বান জানান।
সভায় উপস্থিত বক্তারা বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ধর্মান্ধতা থেকে মুক্ত করতে হবে; মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট এস.এম.এ. সবুর বলেন, প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া নারী নির্যাতন, যৌন নির্যাতনের ঘটনায়-শিশুও রেহাই পাচ্ছে না। পরিস্থিতির উত্তরণে একই প্ল্যাটফর্মে থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে সামাজিক প্রতিরোধ আন্দোলন করতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি, লেখক ও গবেষক মফিদুল হক বলেন, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের ক্ষেত্রে নীতিমালা করতে হবে; গণমাধ্যমকে আরো তৎপর হতে হবে। ছাত্রদের রাজনৈতিক প্রশ্রয়ের বলয় থেকে মুক্ত করতে হবে;
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চন্দ্রনাথ পোদ্দার বলেন, আইনের শাসন জোরালো না হলে সামাজিক অনাচার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই থাকবে। পরিবার থেকে সন্তানদের মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন সুশিক্ষা দিতে হবে; মিডিয়াতে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে মত-বিনিময় সভার আয়োজন করতে হবে, প্রণীত আইনের বাস্তবায়নের উপর জোর দিতে হবে।
ঢাবি’র পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মাইনুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটিকে শক্তিশালী করতে হবে; কমিটিকে রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে গিয়ে শূন্য সহিষ্ণুতার নীতি নিয়ে নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করতে হবে; সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে রিপোর্ট প্রদান এবং শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করতে হবে; বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরির করতে হবে; কাউন্সেলিং পরিসেবার ক্ষেত্র বিভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত করতে হবে, ছাত্র ও ছাত্র উপদেষ্টার মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে হবে; নিম্ন মাধ্যমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষা কারিকুলামে প্রজনন স্বাস্থ্যের বিষয়টি যুক্ত করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম বলেন, বর্তমানে সংঘটিত সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে নতুন প্রজন্মকে গড়ে তুলতে হবে। সংবাদপত্রে নারীর প্রতি যে সকল সহিংসতার খবর প্রকাশিত হয় তা খুবই দুঃখজনক। এই ঘটনাগুলো সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করছে, যা নিয়ে আমরা চিন্তিত।
তিনি বলেন, গ্রামে সংঘটিত যৌন নিপীড়নের ঘটনার প্রতিরোধ, পর্যবেক্ষণের জন্য একটি কমিটি থাকা আবশ্যক। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার যদি আমরা অর্জন করতে পারি তাহলে আজকের আলোচনার বিষয় ফলদায়ক হবে। এবিষয়গুলো স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে হবে।
সভায় সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট এস.এম.এ. সবুর; সাংবাদিক বাসুদেব ধর; ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন; দীপ্ত টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফুয়াদ চৌধুরী; ব্যারিস্টার এ কে রাশেদুল হক; বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক; মনি সিংহ-ফরহাদ ট্রাস্টের সভাপতি শেখর দত্ত, সাধারণ সম্পাদক মুকুল চৌধুরী বক্তব্য রাখেন।