ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছেন সংস্কারপন্থী নেতা মাসুদ পেজেশকিয়ান। শুক্রবার অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় দফা ভোটে কট্টরপন্থী সাঈদ জালিলিকে পরাজিত করে সংস্কারপন্থী এই নেতা ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান একজন স্বল্পপরিচিত মধ্যপন্থী রাজনীতিবিদ। হৃদরোগের চিকিৎসক থেকে তিনি দেশটির ১৪তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন।
মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটির নতুন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের আগ্রহও রয়েছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, পেজেশকিয়ানকে ভোট দেওয়া অধিকাংশ মানুষই শহুরে মধ্যবিত্ত এবং তরুণ বলে মনে করা হচ্ছে। তারা ইসলামপন্থী গোঁড়ামির কারণে ইরানে বহু বছর ধরে চলমান সামাজিক নিরাপত্তা লঙ্ঘনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন।
দুর্ঘটনায় নিহত সাবেক প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গির বেশ ফারাক রয়েছে নতুন প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ানের।
দেশটিতে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার কারণে রাষ্ট্রীয় নীতি, পরমাণু কর্মসূচি বা পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সম্পর্কে কতটা পরিবর্তন আনতে পারবেন পেজেশকিয়ান সেটি নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।
ইব্রাহিম রাইসির চেয়ে নীতিগত অবস্থানে ভিন্নতা থাকলেও ইরানের নতুন প্রেসিডেন্টকে পশ্চিমা বিশ্বের কোন দেশ কী স্বাগত জানাবে, এমন প্রশ্নও রয়েছে।
তবে পেজেশকিয়ান নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় এরই মধ্যে শুভেচ্ছা জানিয়েছে ভারত, চীন ও রাশিয়ার নেতারা।
শুক্রবার ভোট গণনা করার পরই পেজেশকিয়ানকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। তিনি পেয়েছেন ৫৩ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট। প্রতিদ্বন্দ্বী জালিলি পেয়েছেন ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট।
৭১ বছর বয়সী পেজেশকিয়ান ইরানের উপ-স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং পরে সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামির প্রশাসনের অধীনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
গত মে মাসে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যুর পরই নতুন মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘোষণা দেয় ইরান।
হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ থেকে প্রেসিডেন্ট
ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট ৭১ বছর বয়সী মাসুদ পেজেশকিয়ান একজন হৃদরোগ বিষয়ক সার্জন। তিনি ২০০৮ সাল থেকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় তাবরিজ শহর থেকে ইরানের পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করে আসছেন। তিনি সংসদে ডেপুটি স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ইরানের মাহাবাদে জন্মগ্রহণ করেন মাসুদ পেজেশকিয়ান।
শুরুতে তিনি হার্ট সার্জন হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। পরে তাবরিজ ইউনিভার্সিটি অব মেডিকেল সায়েন্সের প্রধান হন।
রাজনীতিতে প্রবেশ করে পেজেশকিয়ান ইরানের উপ-স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং পরে সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামির প্রশাসনের অধীনে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮০ সালের ইরাক ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধের সময় মাসুদ পেজেশকিয়ানকে সম্মুখ সারির চিকিৎসকের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল।
নির্বাচনের আগে ইরানের প্রধান সংস্কারপন্থী জোটের সমর্থন পাওয়ার পাশাপাশি সাবেক দুই সংস্কারপন্থী প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ খাতামি ও হাসান রুহানিরও সমর্থন পেয়েছিলেন তিনি।
২০১১ সালে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য নিবন্ধন করলেও পেজেশকিয়ান তা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।
১৯৯৪ সালে মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি তার স্ত্রী ও এক কন্যা সন্তানকে হারান। পরবর্তীতে তিনি তার কখনো বিয়ে করেননি। বর্তমানে তিনি দুই ছেলে এবং এক মেয়ে সন্তানকে নিয়ে বসবাস করছেন।
যে কারণে তরুণদের বেশি সমর্থন
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, পেজেশকিয়ানকে ভোট দেওয়া অধিকাংশ মানুষই শহুরে মধ্যবিত্ত এবং তরুণ বলে মনে করা হচ্ছে। তারা ইসলামপন্থী গোঁড়ামির কারণে ইরানে বহু বছর ধরে চলমান সামাজিক নিরাপত্তা লঙ্ঘনে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন।
২০২২ সালে পোশাক বিধি লঙ্ঘন করায় নৈতিক পুলিশের নির্যাতনে মাশা আমিনি নামের এক তরুণীর মৃত্যুর পরই ওই ঘটনার সমালোচনা করে আলোচনায় এসেছিলেন পেজেশকিয়ান।
ওই তরুণীর মৃত্যুর পর পুরো ইরান জুড়ে তখন ব্যাপক আকারে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
পেজেশকিয়ান তখন ওই ঘটনায় কর্তৃপক্ষের কাছে এ নিয়ে ব্যাখ্যাও চেয়েছিলেন।
তখন তিনি বলেছিলেন, একটি মেয়েকে তার হিজাবের জন্য গ্রেপ্তার করা এবং পরবর্তীতে তার মৃতদেহ পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া ইসলামি প্রজাতন্ত্রে অগ্রহণযোগ্য।
গত ২৮ জুন অনুষ্ঠিত ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রথম দফায় ভোট দিয়ে পেজেশকিয়ান বলেছিলেন, হিজাব আইনের প্রতি আমাদের সম্মান জানানো উচিত। কিন্তু এর জন্য নারীদের প্রতি অমানবিক আচরণ করা উচিত নয়।
দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের আগে এক ভিডিও বার্তায় নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান ভোটারদের উদ্দেশে বলেছেন, চেষ্টা করেও আমি যদি আমার নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হই, তবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বিদায় জানাব।
পরিবর্তন আনতে পারবেন নতুন প্রেসিডেন্ট?
ধর্মীয় নেতা ও প্রজাতান্ত্রিক শাসন— এমন দ্বৈত ব্যবস্থায় পরিচালিত হয় মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরান।
পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের তীব্র টানাপড়েন চলছে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তেহরান সমর্থিত মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।
পেজেশকিয়ান নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর প্রশ্ন উঠেছে এমন অবস্থায় এসব ইস্যুতে কোন পথে হাটবে ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর বলছে, দেশটিতে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার কারণে রাষ্ট্রের নীতিগত অবস্থানে বদল আনার ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের নেই।
কেননা, দেশের শীর্ষ রাষ্ট্রীয় সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। তবে প্রেসিডেন্ট ইরানের নীতির ধরনকে শুধু প্রভাবিত করতে পারেন।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, আয়াতুল্লাহ খামেনি সমর্থিত সাবেক প্রেসিডেন্ট রাইসির সঙ্গে পেজেশকিয়ানের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই ভিন্ন।
কেননা, নারীদের পোশাকের স্বাধীনতায় লাগাম টানতে কড়াকড়িভাবে আইনের প্রয়োগ করেছিলেন রাইসি। তবে এর বিরুদ্ধে অবস্থান পেজেশকিয়ানের।
পরমাণু চুক্তি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ইরানের ঝিমিয়ে পড়া আলোচনায় গতি আনার বিষয়েও কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন রাইসি।
এই ইস্যুতে নতুন প্রেসিডেন্টের অবস্থান কী হবে তা নিয়ে অনেকেরই মনে প্রশ্ন রয়েছে।
পেজেশকিয়ান অব্যবস্থাপনা, রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি এবং মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, প্রেসিডেন্টের চারপাশ ঘিরে আছেন সর্বোচ্চ নেতা খামেনির অনুগত ব্যক্তিরা। এ অবস্থায় দেশে রাজনৈতিক বহুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তেহরানের একঘরে অবস্থা কাটানোর চেষ্টা করেও কতখানি সফল হবে নতুন প্রেসিডেন্ট তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে অনেকের।
তবে সাধারণ ইরানিরা মনে করছেন, সংস্কারপন্থী পেজেশকিয়ান চেষ্টা করলেও দেশটির শাসক তাকে বড় ধরনের কোনও পরিবর্তন করতে দেবে না।
নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ও সংগরিষ্ঠতা
নির্ধারিত সময়ে আগামী বছরের জুনে ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু গত ১৯ মে ইব্রাহিম রাইসি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মারা গেলে প্রেসিডেন্ট পদটি শূন্য হয়ে যায়।
ইরানের সংবিধান অনুযায়ী ৫০ দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচন আয়োজনের বাধ্যবাধকতা থাকায় প্রেসিডেন্ট পদে নতুন ২৮ জুন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে দেশটি।
২৮শে জুনের নির্বাচনে কোনও প্রার্থীই ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পাওয়ায় নিয়ম অনুযায়ী শুক্রবার ৫ জুলাই দ্বিতীয় দফার ভোট অনুষ্ঠিত হয়।
প্রথম দফার ভোটে ৪২ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রথম অবস্থানে ছিলেন পেজেশকিয়ান। বিপরীতে ৩৯ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় ছিলেন জালিলি।
প্রথম দফায় পেজেশকিয়ান ও জালিলি ছাড়া কট্টরপন্থী পার্লামেন্ট স্পিকার মোহাম্মদ বাঘের গালিবাফ এবং কট্টরপন্থী মোস্তফা পুরমোহাম্মদিও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
ইরানে মোট ভোটার সংখ্যা ৬ কোটির ওপরে। দ্বিতীয় দফার ভোটেও এই দুই প্রার্থী ছিলেন নির্বাচনীয় লড়াইয়ে।
ইরানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দ্বিতীয় দফায় তিন কোটির বেশি ভোট গণনার পর মাসুদ পেজেশকিয়ান পেয়েছেন ১ কোটি ৭০ লাখের বেশি ভোট। যা প্রাপ্ত ভোটের ৫৩ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট।
অপরদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী সাইদ জালিলি পেয়েছেন ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি ভোট। জলিলির ভোট ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
ইরানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক ফলাফল ঘোষণার আগেই ডা. পেজেশকিয়ানের সমর্থকরা তেহরান ও অন্যান্য কয়েকটি শহরে বিজয় উদযাপনের জন্য রাস্তায় নামে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হওয়া বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে, যারা বিজয় উল্লাসে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন তাদের বেশিরভাগই তরুণ।
কেউ বের হয়েছিলেন গাড়ি নিয়ে, সবুজ পতাকা হাতে কেউ কেউ নেমেছিলেন রাস্তায়।