স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অন্যতম সদস্য প্রবীণ ফুটবলার শেখ আশরাফ আলী। এখনো দেশের ফুটবলের খোজখবর রাখেন। নারী ফুটবলের সংকটে তিনি সরাসরি নারী ফুটবলারদের পাশেই দাঁড়ালেন, ‘এই মেয়েরাই তো মাঠে খেলে চ্যাম্পিয়ন করেছে। যখন কোচের সঙ্গে সমস্যা ছিল সেই কোচকে পুনরায় ওদের সঙ্গে আলোচনা না করে নেয়া কোনোভাবেই ঠিক হয়নি। এখন যদি এই মেয়েরা সত্যিই শেষ পর্যন্ত না খেলে তাহলে তো আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্যের ধারাবাহিকতা থাকবে না।’
২০১৬ এসএ গেমসে রেকর্ডসহ দুই স্বর্ণ পদকজয়ী সাতারু মাহফুজা খাতুন শিলা নারী ফুটবলের সংকটে সাবিনাদের পাশেই দাঁড়ালেন, ‘১৫-১৬ জনের বেশি জন একসঙ্গে একটি দাবি বা অবস্থান নেন সেখানে অবশ্যই কোনো কারণ বা যৌক্তিকতা রয়েছে। ফেডারেশনের আগেই উচিত ছিল বিষয়টি সমাধান করার।’ ২০১৬ ও ২০১৯ এসএ গেমসে ভারত্তোলনে স্বর্ণপদকজয়ী ভারত্তোলক মাবিয়া আক্তার সীমান্তও ফুটবলারদের পাশে অবস্থান নিলেন, ‘বাংলাদেশে ক্রীড়াবিদরা বরাবরই উপেক্ষিত। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে সাফল্য আনার জন্য চাপ, সাফল্য আনার পর এক পর্যায়ে উপেক্ষিত। এই সংস্কৃতির অবশ্যই পরিবর্তন প্রয়োজন।’
‘মেয়েরা এই কোচের অধীনে অনুশীলন করবে না বললে বলছে। যারা খেলবে তাদের সঙ্গে কোচের স্বাচ্ছন্দ্য প্রয়োজন রয়েছে। ফলে ফেডারেশন চাইলে কোচ পরিবর্তন করতেই পারে।’-যোগ করেন তিনি।
বৃটিশ কোচ পিটার বাটলার সাফের আগেও জুনিয়রদের প্রাধান্য দেয়ার মানসিকতায় ছিলেন গতকাল সুস্পষ্ট বলেছেন অনূর্ধ্ব-২০ ফুটবলার দিয়ে তিনি জাতীয় দল তৈরির পরিকল্পনা করছেন। এ নিয়ে বেশ দ্বিমত পোষণ করে দেশের সাবেক তারকা ক্রীড়াবিদ ও বর্তমান কোচ বলেন, ‘অবশ্যই ভবিষ্যত প্রজন্ম বা বিকল্প তৈরি করতে হবে। কিন্তু তাই বলে জুনিয়র যদি সিনিয়রকে বিট করার পর্যায় না থাকে এরপরও জোর করে সিনিয়রদের বিকল্প তৈরি করা নিষ্প্রয়োজন।’
জাতীয় নারী দলের সাবেক অধিনায়ক ডালিয়া আক্তার এখন হ্যান্ডবল কোচ। এরপরও ফুটবলের খোঁজ রাখেন সব সময়। সাবেক এই অধিনায়ক তার অনুজদের পাশে দাঁড়াতে পারলেন না, ‘তারা যে কারণগুলো বলেছেন এই কোচের অধীনে অনুশীলন না করার সেগুলো আমার কাছে যৌক্তিক মনে হয়নি। কোন খেলোয়াড়কে কখন, কতটুকু খেলাবে সেটা সম্পূর্ণ কোচের পরিকল্পনার অংশ এবং এটা তার দায়িত্ব। খেলোয়াড়দের দাবির প্রেক্ষিতে কোচ পরিবর্তন করলে সেটা শৃঙ্খলা বহির্ভূত হবে। সামনেও এ রকম আন্দোলন দাবী দেখা যেতে পারে। ডালিয়ার মতো আরো কয়েকজন সাবেক ক্রীড়াবিদ এমন ধারণা পোষণ করেন।’
ক্রীড়াঙ্গনের প্রতিবাদী কন্ঠস্বর সাবেক তারকা ক্রীড়াবিদ ও সংগঠক কামরুন নাহার ডানা। নারী ফুটবলে সাফল্য আসলেও ফেডারেশনের দল ব্যবস্থাপনার ত্রুুটি নিয়ে বরাবরই সরব ছিলেন। বিশেষ করে নারী ফুটবল দলে পুরুষ ম্যানেজার করার আপত্তি দীর্ঘদিন থেকে করে আসছিলেন। নারী ফুটবলে উদ্ভুত সংকটে তিনি এতটাই বিরক্ত কোনো মন্তব্য করতে আগ্রহী নন।
নারী ফুটবলে উদ্ভত ঘটনায় জাতীয় পুরুষ ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক জাহিদ হাসান এমিলির পর্যবেক্ষণ, ‘সাফের সফলতার পেছনে খেলোয়াড় ও কোচ উভয়ের ভূমিকা রয়েছে। দুই পক্ষের সঙ্গে ফেডারেশন এখনো ভালো মতো বসলে সমাধান হওয়া সম্ভব। এজন্য দুই পক্ষকে নমনীয় হতে হবে।’
নারী ফুটবলে উদ্ভুত ঘটনায় ২০০৯ সালে ব্রাজিলিয়ান কোচ এডসন সিলভা ডিডোর বিকেএসপির ক্যাম্পে সাত ফুটবলারের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। জাহিদ হোসেন, রজনী কান্ত বর্মণ, ওয়ালী ফয়সাল, মোফাজ্জল হোসেন সৈকত, আরমান আজিজ, জাহিদ হাসান এমিলি বিকেলের অনুশীলনে এক পর্যায়ে অপরাগতা প্রকাশ করেন। এরপর থেকে তাদের বাদ দিয়ে অনুশীলন হয়।
সেই স্মৃতি স্মরণ করে এমিলি বলেন, ‘আসলে এটা একটা ভুল বোঝাবুঝি ছিল। বিকেলে পাসিং ড্রিলে দুই একজন ভুল করছিল বারবার। এতে কোচ বিরক্ত হয়ে পাসিংয়ের পরিবর্তে আবার রানিং দেন। অথচ সকালে আমরা অনেক হার্ড রানিং করেছিলাম। এরপরও বিকেলে সেই রানিং করতে থাকি। এক পর্যায়ে সেই জিজ্ঞেস করে কে কে এটা পারবে আর পারবে না। আমরা কয়েকজন সরলমনে না অংশে দাড়াই। এরপর কোচ আমাদের বাদ দিয়ে কাজ করতে থাকে।’
ডিডোর ঘটনার থেকে বাটলারের ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন বলে মন্তব্য করলেন সেই সময় ডিডোর সঙ্গে থাকা দেশীয় কোচ শফিকুল ইসলাম মানিক, ‘সকালে হার্ড ট্রেনিং হয়েছিল। এরপর বিকেলেও একটি ভুলের প্রেক্ষিতে পুনরায় হার্ড ট্রেনিং দিয়েছিলেন কোচ। যেটা আসলেই অমানবিক ছিল। যা ট্রেইনারের অবহিত করা প্রয়োজন ছিল। আর নারী ফুটবলারদের সঙ্গে কোচের বিষয়টি হচ্ছে ইগোগত। আশা করি বিশেষ কমিটি এই বিষয়ে একটা সুন্দর অবস্থানে পৌঁছাতে পারবে।’
২০০৯ সালে সেই ঘটনায় খেলোয়াড়দের বহিষ্কারের আলোচনাও ছিল। জাতীয় দল কমিটির সেই সময়ের চেয়ারম্যান বাদল রায় প্রকৃত ঘটনা জেনে সেই দিকে আর যাননি। পরবর্তীতে কোচ ডিডো সাত জনের মধ্যে দুই জনকে দলে নিয়েছিলেন। কোচের খেলোয়াড় বাছাইয়ের স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দিয়ে দেশের শীর্ষ কোচ শফিকুল ইসলাম মানিক বলেন, ‘ব্রাজিল কোচ এক বিশ্বকাপে রোমারিওকে নেয়নি। এ নিয়ে সারা বিশ্বে সমালোচনা হলেও কোচ তার অবস্থানে ছিলেন। কোচ যদি তার সিদ্ধান্তে অনড় থেকে সফলতা আনতে পারে ভালো আর না পারলে তখন তাকে সমালোচনা বা ব্যর্থতা নিয়ে বিদায় নিতে হয়।’