অর্থনৈতিকভাবে ভয়াবহ বিপর্যয় ও দেউলিয়া হওয়ার মাত্র দেড় বছরের মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে শ্রীলঙ্কা। অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের পর দেশটির রাজনীতিতেও নেমে আসে চরম অমানিশা। ব্যাপক বিক্ষোভ ও সহিংসতার মুখে পদত্যাগ করে সেই সময়ের শ্রীলঙ্কার সরকার। দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপকসেও। তবে খুব শিগগিরই নিজেদের ভাগ্য ফেরাতে শুরু করেছেন শ্রীলঙ্কানরা। এটা অনেকটা গল্পের আলাদিনের চেরাগের মতো।
২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা জর্জরিত হয়ে পড়েছিল বৈদেশিক ঋণে। আমদানি ব্যয় মেটাতে পারছিল না দেশটি। তীব্র সংকট দেখা দিয়েছিল জরুরি খাদ্যপণ্য, ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের। দাম উঠেছিল আকাশে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়েও মিলছিল না জ্বালানি তেল ও গ্যাস। শ্রীলঙ্কার এমন সব ঘটনার সাক্ষী বিশ্ব।
সেই দুর্ভোগ অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে শ্রীলঙ্কা। জমে উঠতে শুরু করেছে দেশটির অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি পর্যটন খাত এবং জ্যামিতিক হারে বাড়ছে দেশটির রেমিট্যান্স। এ ধারা অব্যাহত থাকলে শিগিগরই দেশটির অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
২০২২ এর সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে এ বছরের জুলাইয়ের ৬ দশমিক ৩ শতাংশে এসে দাঁড়ায় মূল্যস্ফীতির হার। আগস্টে তা কমে হয় ৪ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক আশাবাদ প্রকাশ করেছে, আরও বেশ কয়েক মাস মূল্যস্ফীতির এই নিম্নমুখী ধারা অব্যাহত থাকবে।
দেশটি গত বছর ৪৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়ে ‘দেউলিয়া’ হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থার (আইএমএফ) কাছ থেকে মার্চে ৪ বছর মেয়াদি ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারের বেলআউট প্যাকেজ পায় দেশটি। এ মাসেই আইএমএফের একটি দল শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম নিরীক্ষা করতে আসবে। তাদের সফরের ওপর নির্ভর করবে ৩৩০ মিলিয়ন ডলারের পরবর্তী কিস্তি পাওয়ার বিষয়টি।
আইএমএফ সম্প্রতি জানিয়েছে, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখালেও দেশটিকে আরও কিছু কষ্টদায়ক সংস্কারের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
গোতাবায়াকে উৎখাতের পর তার উত্তরসূরি রনিল বিক্রমাসিংহে দ্বিগুণ হারে কর আরোপ করেছেন, জ্বালানি খাত থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহার করেছেন এবং রাষ্ট্রীয় রাজস্ব বাড়াতে কয়েক দফায় জ্বালানির দাম বাড়িয়েছেন।
তবে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি যে ফের শক্ত হচ্ছে তার প্রমাণ সম্প্রতি দেশটি বাংলাদেশ থেকে নেয়া অর্থ ফেরত দিয়েছে। বাংলাদেশের ঋণের ৭৫ শতাংশ ফেরত দিয়েছে শ্রীলঙ্কা। এমনকি অন্যান্য দেশ ও সংস্থার ঋণও এখন একটু একটু করে পরিশোধ করে দিচ্ছে শ্রীলঙ্কা।
দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তিন কোটি ৮০ লাখ ডলার বেড়ে হয়েছে ৩৭৬ কোটি ২০ লাখ ডলার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো জাদুবলে নয় বরং নীতিগত কিছু সিদ্ধান্তের ফলে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে প্রায় ধ্বংসের কাছে যাওয়া শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি। দেশটির অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন পর্যটন খাতে সুদিন ফিরছে, রেমিট্যান্স বাড়ছে, শিল্প উৎপাদন বাড়ছে এবং কৃষি উৎপাদনও ভালো হচ্ছে। ফলে রপ্তানি আয়ের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির পটপরিবর্তন নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। সেখানে শ্রীলঙ্কার ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে দুটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক প্রিয়াঙ্গা দুনুসিংহে।
তিনি বলেন, ‘সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু নীতি পরিস্থিতির উন্নতিতে ভূমিকা রেখেছে। এর ফলে রেমিট্যান্স ও পর্যটনের মতো কিছু ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় পুনরুদ্ধার হয়েছে। এ দুটির সমন্বয়েই পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে আরো অনেক দূর যেতে হবে।’
সরকার ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব বাড়িয়েছে এবং সংস্কার কার্যক্রম জোরদার করে করজাল বিস্তৃত করেছে। এর ফলও অর্থনীতিতে দেখা যাচ্ছে বলে মনে করেন অধ্যাপক দুনুসিংহে। তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন ঋণদাতা দেশ এবং আইএমএফের মতো সংস্থার সঙ্গে সরকার আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে রপ্তানি বাড়তে শুরু করেছে। রেমিট্যান্স অনেক গুণ বেড়েছে। আবার পর্যটনের মতো খাত ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। পাশাপাশি গত বছর বিপুল পরিমাণ দক্ষ ও আধা দক্ষ শ্রমিক বিদেশে গেছেন।’
কলম্বোর সাংবাদিক শিহার আনিজ বিবিসিকে বলেন, দোকানে পণ্য নেই কিংবা কিছু থাকলেও অনেক দাম, অথচ মানুষের দীর্ঘ লাইন— বিপর্যয়কর সেই অবস্থা এখন আর নেই শ্রীলঙ্কায়। বরং দাম বেশি থাকলেও নিত্য দরকারি সব কিছুর সরবরাহ এখন বাজারে স্বাভাবিক হয়েছে। জীবনযাত্রাও সে সময়ের তুলনায় এখন অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। যদিও তিনি মনে করেন সংকট থেকে এখনো পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারেনি দেশটি। বরং প্রকৃত অবস্থা কী হয় সেটা বোঝা যাবে, যখন দেশটি বিদেশি ঋণ পরিশোধ করা শুরু করবে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী ২০২৩ সালেও জিডিপি হ্রাসের প্রবণতায় থাকবে শ্রীলঙ্কা। তবে ২০২৪ সাল থেকে ধীরে ধীরে এটি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে। যদিও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ ও দেশের বাইরে থেকে শ্রীলঙ্কার এখন মোট ঋণের পরিমাণ ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। কোনো কোনো সংস্থার হিসাবে এই ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১১ বিলিয়ন ডলারের বেশি শোধ করতে হবে চীন, জাপান এবং ভারতকে। আবার মোট ঋণের মধ্যে ২৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করতে হবে ২০২৭ সালের মধ্যে। সরকার ঋণ পুনর্বিন্যাসের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশ ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। আলোচনা সফল হলে ঋণ ভার কিছুটা হলেও লাঘব হবে দেশটির।
তবে ভয়াবহ যে পরিস্থিতি পার করেছে শ্রীলঙ্কা, আগামীর পরিস্থিতি এমন হবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, আলাদিনের চেরাগ নয়, পরিকল্পনা, জনগণের সহায়তা আর কার্যকর পদক্ষেপই শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে পাল্টে দিয়েছে।