এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে সন্তুষ্ট না হয়ে খাতা চ্যালেঞ্জ করা ১১ হাজার ৩৬২ পরীক্ষার্থীর ফলে পরিবর্তন এসেছে। এর মধ্যে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন এক হাজার ৮১১ জন শিক্ষার্থী, ফেল থেকে পাস করেছেন ২২১২ শিক্ষার্থী। ফেল থেকে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন তিনজন। বাকি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গ্রেডে ফল পরিবর্তন হয়েছে। গত কয়েক বছরের মধ্যে এবার সবচেয়ে বেশি পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে বলে জানা গেছে।
সোমবার (২৮ আগস্ট) এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার খাতা পুনর্নিরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে ১০টি সাধারণ বোর্ডের প্রকাশিত পুনর্নিরীক্ষণের ফল বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য জানা গেছে। বাকি আছে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের ফল, এটি এখনো বোর্ডের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়নি।
বিপুলসংখ্যক পরীক্ষার্থীর ফলাফল পরিবর্তনের পেছনে পরীক্ষকদের গাফিলতি রয়েছে বলে মনে করছেন বোর্ড কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে আন্তঃবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর আবুল বাশার বলেন, ‘সব বোর্ডের তথ্য আমার কাছে নেই। তবে যে তথ্য দেখা গেছে, এটি আসলেই উদ্বেগের বিষয়।’
পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করে ফল পরিবর্তন স্বাভাবিক ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই সংখ্যাটি যদি নির্দিষ্ট পার্সেন্টেজের বাইরে চলে যায় তবে পরীক্ষকদের তথ্য সংগ্রহ করে তদন্ত করি। সব বোর্ডের তথ্য সংগ্রহ করে যদি নির্দিষ্ট পার্সেন্টেজের বাইরে যায় তবে চিহ্নিত পরীক্ষকদের বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দেওয়া হয়। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী অভিযুক্ত বেশিরভাগ পরীক্ষককে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। অপরাধের মাত্রা বেশি হলে তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ করার জন্য মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুনর্নিরীক্ষণে নতুন করে কোনো উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয় না। শুধু উত্তরপত্রে শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বরের যোগ-বিয়োগগুলো দেখা হয়। এতেই এত বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। এটা শুধু পরীক্ষকদের গাফিলতির কারণেই হয়েছে।
২০১৯ সালে টানা তিন বছর ধারাবাহিক গাফিলতির কারণে ১ হাজার ২৬ পরীক্ষককে শাস্তির আওতায় আনে শিক্ষাবোর্ড। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বোর্ডের আইন অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। অভিযুক্ত বেশিরভাগ পরীক্ষককে কালো তালিকাভুক্ত করা, কাউকে সারা জীবনের জন্য কোনো বোর্ডের পরীক্ষক হতে না পারার মতো শাস্তি দেওয়া হয়। তবে যে সব পরীক্ষক খাতা মূল্যায়নে কেলেঙ্কারি বা ক্রাইমে যুক্ত হন, তাদের বেতন-ভাতা বন্ধ এবং চাকরিচ্যুতির নজির রয়েছে।
পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন হওয়া উত্তরপত্রের চারটি দিক দেখা হয়। এগুলো হলো- উত্তরপত্রের সব প্রশ্নের সঠিকভাবে নম্বর দেওয়া হয়েছে কি না, প্রাপ্ত নম্বর গণনা ঠিক রয়েছে কি না, প্রাপ্ত নম্বর ওএমআর শিটে তোলা হয়েছে কি না এবং প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী ওএমআর শিটের বৃত্ত ভরাট করা হয়েছে কি না?
কোন বোর্ডে কত জনের ফল পরিবর্তন
ঢাকা বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষার ১ লাখ ৯১ হাজার খাতা পুনর্নিরীক্ষণের জন্য আবেদন করেছিলেন ৭৩ হাজার ৪৬ পরীক্ষার্থী। এর মধ্যে মোট ৩ হাজার ৮৫ জন পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। প্রকাশিত ফলে অকৃতকার্য ছিল এমন খাতা চ্যালেঞ্জ করে পাস করেছেন ১০৪ জন। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৩৬২ জন। তবে ফেল করা কোনো শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাননি।
চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে মোট ১০৮০ শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। ফেল থেকে পাস করেছেন ১৩০ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১৬২ জন।
বরিশাল বোর্ডের ৭ হাজার ৩৮৬ জন শিক্ষার্থী মোট ২১ হাজার ৩৯৭টি খাতা চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তার মধ্যে মোট ১৭১ জন পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। ফেল থেকে পাস করেছেন ৩ জন শিক্ষার্থী, আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ২৯ জন পরীক্ষার্থী।
যশোর শিক্ষাবোর্ডে মোট ৫৩৪ জন পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে ফেল থেকে পাস করেছেন ৫৪ জন শিক্ষার্থী। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৫২ জন পরীক্ষার্থী। আর একমাত্র এ বোর্ডেই ফেল থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৩ জন পরীক্ষার্থী।
খাতা পুনর্নিরীক্ষণে সিলেট শিক্ষা বোর্ডের ৪৭২ শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে ফেল থেকে পাস করেছেন ৭৯ জন। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৪৯ জন।
রাজশাহী শিক্ষাবোর্ডের মোট ৩৬১ শিক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে ফেল থেকে পাস করেছেন ৪৮ জন শিক্ষার্থী। নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৫৬ জন।
দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডে মোট ৩৭৭ জনের ফলাফল পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে ফেল থেকে পাস করেছেন ৭৫ শিক্ষার্থী। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৭৩ জন। বাকিদের বিভিন্ন গ্রেডে ফল পরিবর্তন হয়েছে।
কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ডে ২৭ হাজার ৬০ জন শিক্ষার্থী মোট ৬৫ হাজার ৪০টি উত্তরপত্র পুনর্নিরীক্ষণের জন্য আবেদন করে। এর মধ্যে ৮৭৯ জনের ফল পরিবর্তন হয়। যার মধ্যে ৯৪ জন নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছেন আর ১৮০ জন ফেল থেকে পাস করেছেন। বাকি ৬০৫ জনের বিভিন্ন গ্রেডে ফল পরিবর্তন হয়েছে।
মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডে মোট ২৩ হাজার ৬৬৫ জন ফল পরিবর্তনের আবেদন করেছিল। এর মধ্যে ৪ হাজার ১৯৫ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। আর ফেল থেকে নতুন করে পাস করেছে ১ হাজার ৫৩৪ জন, নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৫৯৭জন।
এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের পুনর্নিরীক্ষণের ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরীক্ষকদের উদাসীনতায় পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত ফলাফলে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এতে অনেকেই তার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল থেকে বঞ্চিত হন। ফল প্রকাশের পর এসব শিক্ষার্থী চ্যালেঞ্জ করলে প্রায় তিন হাজারের বেশি পরীক্ষার্থীর ফল পরিবর্তন হয়েছে। উত্তরপত্র নতুন করে মূল্যায়ন করলে এ সংখ্যা আরও বেশি হবে।
তবে প্রতি বছরই এ ঘটনা ঘটলেও দায়ী শিক্ষকরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। অল্প সময়ে ফল প্রকাশ করতে গিয়ে পরীক্ষকদের দ্রুত সময়ে খাতা মূল্যায়ন করারও একটা চাপ থাকে। এ চাপ সামলাতে গিয়ে পরীক্ষকরা এ ভুল করছেন বলে মনে করেন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এ বিষয়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড ও আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তপন কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, চলতি বছর সব বিষয়ে পূর্ণ নম্বরে পরীক্ষা হয়েছে। এ ব্যাচটিতেও করোনার প্রভাব ছিল। তাই ফলাফল একটু খারাপ হয়। সংগত কারণে এবার পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন বেশি পড়েছে। এটাতে অস্বাভাবিক কিছু দেখছি না। তবে অন্য বছরের তুলনায় যদি বেশি হয় তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুনর্মূল্যায়নে যেসব বিষয় দেখা হয়
বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন হওয়া উত্তরপত্রের চারটি দিক দেখা হয়। এগুলো হলো— উত্তরপত্রের সব প্রশ্নের সঠিকভাবে নম্বর দেওয়া হয়েছে কি না, প্রাপ্ত নম্বর গণনা ঠিক রয়েছে কি না, প্রাপ্ত নম্বর ওএমআর শিটে উঠানো হয়েছে কি না ও প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী ওএমআর শিটের বৃত্ত ভরাট করা হয়েছে কি না। এসব পরীক্ষা করেই পুনর্নিরীক্ষার ফল দেওয়া হয়।
তবে, পরীক্ষক কোনো প্রশ্নের উত্তরের জন্য যে নম্বর দিয়ে থাকেন সেটি পরিবর্তনের সুযোগ নেই। যেমন— পরীক্ষক একটি প্রশ্নের উত্তরের জন্য ৬ নম্বর দিয়েছেন; সেটি ভুলবশত ৩ নম্বর হিসেবে গণনা করা হলো; এ ধরনের ভুল সংশোধন করা হয়। এক্ষেত্রে কোনোভাবে যেন পরীক্ষার্থী ক্ষতিগ্রস্ত না হয় তা বিবেচনায় রাখা হয়। কিন্তু এই ৬ নম্বরের জায়গায় ৮ নম্বর দেওয়ার সুযোগ নেই।