ব্যবসা-বাণিজ্যে করোনার নেতিবাচক প্রভাবের কারণে গত দেড় বছরে বকেয়া এলসির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১৪০ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় এটা ১২ হাজার ৪০ কোটি টাকার বেশি। উদ্যোক্তাদের সক্ষমতার অভাবে এসব দেনা পরিশোধ আগে স্থগিত করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েক দফায় এগুলো পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়েছে। ১ অক্টোবর থেকে বেশিরভাগ বকেয়া এলসি পরিশোধ করতে হচ্ছে। এছাড়াও স্থগিত অন্যান্য বৈদেশিক ঋণের কিস্তিও এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। এসব কারণে ব্যাংকগুলোতে হঠাৎ করে ডলারের চাহিদা বেড়েছে। এতে বেড়েছে দাম।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, যে কোনো দুর্যোগে হঠাৎ করে মুদ্রার হাতবদল স্থবির হয়ে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে অর্থের জোগান বাড়িয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। যেমনটি হয়েছিল ২০০৮ সালের মার্কিন অর্থনীতিতে মন্দার সময়ে। ওই সময়ে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে ডলারের জোগান বাড়িয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে। পরে দেওয়া অর্থ ফেরত নেওয়া হয়। গত করোনায়ও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিশ্বের প্রায় সব কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারে মুদ্রার সরবরাহ বাড়িয়েছে। সেগুলো এখন ধীরে ধীরে পরিশোধ হচ্ছে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বাড়ছে। এ পরিস্থিতি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কাজ করতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ও চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে প্রায় ১৪০ কোটি ডলার বা ১২ হাজার ৪০ কোটি টাকার এলসির দেনা বকেয়া পড়েছে। এর মধ্যে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ১২৪ কোটি ডলার। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ১৪ কোটি ডলার। করোনার ভয়াবহতা গত বছরের তুলনায় এবার কম হওয়ার কারণে ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কম। যে জন্য এবার স্থগিত এলসির দেনাও কম বেড়েছে।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, বকেয়া এলসির পরিমাণ আরও বেশি হতো। ব্যবসা চালু রাখার স্বার্থে অনেক উদ্যোক্তা যে কোনোভাবে হোক বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে স্থগিত এলসির দেনা শোধ করে এখন নতুন করে এলসি খুলছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে খোলা ব্যাক টু ব্যাক এলসি (রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য খোলা এলসি) দেনা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬১ কোটি ডলার। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এ খাতে কোনো এলসি বকেয়া ছিল না। স্থগিত এলসির দেনা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৮ কোটি ডলার। গত বছর এর পরিমাণ ছিল ৩৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। ২০১৮ সালে ছিল ৩৯ কোটি ডলার, ২০১৭ সালে ছিল ৪৫ কোটি ডলার। গত কয়েক বছরের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে স্থগিত এলসির দেনা। এগুলো এখন পরিশোধ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ব্যবসা চালু রাখতে হলে এলসির দেনা নির্ধারিত সময়েই শোধ করতে হবে। তা না করলে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবসা এগিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না। যে জন্য আগে বকেয়া এলসি ছিল খুবই কম। করোনার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সহায়তা দেওয়ায় এ দেনা বেড়েছে। তবে এখন রপ্তানি স্বাভাবিক হওয়ায় আগের দেনা সমন্বয় করা হচ্ছে।
বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের নীতিমালা অনুযায়ী, এলসি খোলার সময় ক্রেতা-বিক্রেতার পক্ষে ব্যাংকের মধ্যে চুক্তি হয়। এতে এলসির দেনা কিভাবে পরিশোধ করা হবে তার শর্ত উল্লেখ থাকে। তবে নীতিমালা অনুযায়ী তা ৩ থেকে ৪ মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। তা না করলে পরবর্তী তিন মাসের মধ্যে উদ্যোক্তা খেলাপি হয়ে পড়বেন। তখন আর নতুন এলসি খুলতে পারবেন না। এ কারণে এলসির দেনা শোধে কেউ সাধারণত পিছিয়ে থাকেন না। আর কোনো কারণে উদ্যোক্তা পরিশোধ না করতে পারলেও ব্যাংক ফোর্স লোন সৃষ্টি করে এলসির দেনা শোধ করে দেয়। এ কারণে আগে বকেয়া এলসি খুবই কম ছিল। যেগুলো বকেয়া থাকত সেগুলোও ছয় থেকে এক বছরের মধ্যে বেশির ভাগই মিটে যেত। কিন্তু করোনার কারণে স্বয়ং কেন্দ্রীয় ব্যাংকই এলসির দেনা শোধের মেয়াদ বাড়িয়েছে। বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকও এলসির দেনা শোধ বা রপ্তানির বিল দেশে আনার মেয়াদ বৃদ্ধি করেছে।