তামাক দ্রব্যের দাম সবচেয়ে কম— বিশ্বের এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ২০১৮ সালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় মিয়ানমারের পরেই বাংলাদেশে সবচেয়ে কম দামে সিগারেট পাওয়া যায়। জর্দা-গুলের মতো ধোঁয়াহীন তামাক আরও সস্তা। কম দামে এসব পাওয়া যায় বলেই বাংলাদেশে তামাকের ব্যবহার কমছে না বা তামাকের ব্যবহার কমানোর পেছনে অন্যতম বড় প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করে তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো।
এমন প্রেক্ষিতে প্রতিবছরই বাজেট ঘোষণার আগে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেলের (এনটিসিসি) কাছে তামাকপণ্যে কর বাড়ানোর দাবি জানায় তামাকবিরোধী সংগঠনগুলো ও ডব্লিউএইচও। তাদের প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে কর বাড়ানোর প্রস্তাব করে এনটিসিসি। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তামাকবিরোধী সংগঠন ও ডব্লিউএইচও’র প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে এবারও তামাক কর বাড়ানোর বিষয়ে এনবিআরকে সুপারিশ করেছে এনটিসিসি। ফলে এনবিআর এনটিসিসির সুপারিশ বিবেচনায় নিলে গত অর্থবছরের মতো এবারও সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুলসহ অন্যান্য তামাকজাত দ্রব্যের দাম বাড়বে।
আগামী অর্থবছরে (২০২১-২২) তামাক কর বাড়ানোর বিষয়ে এনবিআরকে সুপারিশ করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন এনটিসিসির যুগ্মসচিব ও সমন্বয়কারী জিল্লুর রহমান চৌধুরী। গত ১১ এপ্রিল তিনি বলেন, ‘সপ্তাহের বেশি সময় হবে এনবিআরে আমরা তামাক কর বিষয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। তাতে কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এখানে যে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, তাতে দেশের মানুষের উপকার হবে।’
সূত্র বলছে, এনটিসিসিকে তামাকবিরোধী সংগঠন ও ডব্লিউএইচও যে প্রস্তাব দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, সেখানে ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে সিগারেটের ক্ষেত্রে সকল ব্র্যান্ডে অভিন্ন করভারসহ (সম্পূরক শুল্ক চূড়ান্ত খুচরা মূল্যের ৬৫%) মূল্যস্তরভিত্তিক সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ (সম্পূরক) শুল্ক প্রচলন করার প্রস্তাব করা হয়। সেখানে নিম্ন স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করে ৩২.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা এবং মধ্যম স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ৭০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার দাবি জানানো হয়।
পাশাপাশি উচ্চ স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১১০ টাকা নির্ধারণ করে ৭১.৫০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক করা এবং প্রিমিয়াম স্তরে প্রতি ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ১৪০ টাকা খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে ৯১ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করার কথা বলা হয়। এছাড়া মধ্য মেয়াদে (২০২১-২২ থেকে ২০২৫-২৬) সিগারেটের ব্র্যান্ডসমূহের মধ্যে দাম ও করহারের ব্যবধান কমিয়ে মূল্যস্তরের সংখ্যা ৪টি থেকে ২টিতে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দেয়া হয়।
এনটিসিসির পাশাপাশি এনবিআরকেও এই প্রস্তাব দিয়েছে বিভিন্ন তামাকবিরোধী সংগঠন ও ডব্লিউএইচও। তামাকবিরোধী সংগঠনগুলোর দাবি, প্রস্তাবিত কর কাঠামো বাস্তবায়ন করা হলে প্রায় ১১ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ী ধূমপান ছেড়ে দিতে উৎসাহিত হবে এবং ৮ লক্ষাধিক তরুণ ধূমপান শুরু করতে নিরুৎসাহিত হবে; দীর্ঘমেয়াদে ৩ লাখ ৯০ হাজার বর্তমান ধূমপায়ী এবং ৪ লাখ তরুণের অকাল মৃত্যুরোধ করা সম্ভব হবে।
এ বিষয়ে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির প্রধান অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, ‘তামাকের সহজলভ্য কমা নির্ভর করে এর দাম কত তার ওপর। কিন্তু আমরা যেটা দেখেছি, বাংলাদেশে যেভাবে তামাকের দাম বাড়ানো হয়, বিশেষ করে ট্যাক্স আরোপ যেভাবে করা হয়, এটা আসলে শতহারে অনেক ট্যাক্স মনে হলেও তামাকের ভিত্তি মূল্য কম হওয়ায় বাজারে তামাক জাতীয় দ্রব্যের দামটা বাড়ে না। ট্যাক্সের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির সঙ্গতি না থাকায় মূল্যস্ফীতি যা হচ্ছে, তাতে তামাক মানুষের আয়ের মধ্যেই থেকে যাচ্ছে।’
আইনকানুনের দুর্বলতা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় আমাদের যে আইনকানুন আছে যেমন ১৮ বছরের নিচে কারও কাছে তামাক বিক্রি করা যাবে না। ১৮ বছরের নিচে কেউ কিনতেও পারবে না। এগুলোর তো আসলে বাস্তবায়ন নাই। যে কেউ তামাক কিনতে পারে।’
সোহেল রেজা চৌধুরী আরও বলেন, ‘খোলা সিগারেট বা তামাক জাতীয় দ্রব্য বিক্রি করা হয় এখানে। ফলে এক প্যাকেট না কিনে ১টা বা দুইটা করে সিগারেট কেনা যায়। সেই কারণে মানুষের তামাক ব্যবহারের হার কমছে না ট্যাক্স বাড়ানোর পরও। তাছাড়া স্কুল, কলেজের ১০০ গজের মধ্যে তামাক বিক্রি করতে পারবে না। এখন সিগারেট প্যাকেটের ৫০ ভাগ সচিত্র সতর্কবার্তা থাকে। সেটা যেন শতভাগ বা ৯০ শতাংশ করা হয়। আর যেখানে বিক্রি করা হয়, সেখানে যেন কোনো বিজ্ঞাপন না থাকে।’
জর্দা, সাদাপাতা, গুল– এগুলো যে ক্ষতি করে এটা অনেকে জানেন না। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে এগুলো বেশি প্রচলিত। কিন্তু তারা জানেন না যে, এটা ক্ষতিকর। এ জায়গায় আরও বেশি সচেতনার প্রয়োজন রয়েছে বলেও মনে করেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির এ প্রধান।