রাজধানীতে ভয়ংকর অপহরণ চক্রের হাত থেকে কোনো রকম প্রাণে বাঁচলেন এক নারী যুগ্ম কমিশনার। নির্যাতনের শিকার মাসুমা খাতুন এনবিআরের যুগ্ম কমিশনারের (ট্যাক্স) কর অঞ্চল-২-এ কর্মরত। এ ঘটনায় তিনজনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। ব্যক্তিগত শৃঙ্খলাজনিত কারণে ভুক্তভোগী তার গাড়ি চালককে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় তাকে অপহরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে এলিট ফোর্স। তবে এর পরিকল্পনা করেন ওই নারীর সাবেক স্বামী।
শনিবার (২৬ আগস্ট) রাজধানী কারওয়ানবাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনের র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, নারী যুগ্ম কর কমিশনারকে অপহরণের পর নির্মম নির্যাতনের ঘটনায় প্রধান আসামি মো. মাসুম ওরফে মাসুদসহ জড়িত তিনজনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। গতকাল রাতে গাজীপুরের শ্রীপুর ও রাজধানীর সবুজবাগ থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার অন্যরা হলেন- মো. আব্দুল জলিল ওরফে পনু ও মো. হাফিজ ওরফে শাহনি।
র্যাব জানায়, গত ১৭ আগস্ট রাত সোয়া আটটায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) একজন নারী যুগ্ম কর কমিশনার রাজধানীর মগবাজার এলাকায় কয়েকজন দুর্বৃত্ত দ্বারা অপহৃত হন। অপহরণের ১৮ ঘণ্টা পর ১৮ আগস্ট রাজধানীর মাদারটেক এলাকা থেকে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে। এ ঘটনায় ভিকটিম তার সাবেক গাড়ি চালক ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে বাদী হয়ে রাজধানীর রমনা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নং ২০/১৭৩। ওই মামলায় তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, গ্রেফতার মাসুদ ভুক্তভোগীর গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গত ১ আগস্ট ব্যক্তিগত শৃঙ্খলাজনিত কারণে ভুক্তভোগী তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেন। ফলে গ্রেফতার মাসুদের মধ্যে ভুক্তভোগীর প্রতি ব্যক্তিগত ক্ষোভ ও আক্রোশের সৃষ্টি হয়। মাসুদ জানান, তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়ায় ভুক্তভোগীর প্রথম স্বামী হারুন অর রশিদ তার সাথে যোগাযোগ করেন এবং ভুক্তভোগীকে উচিত শিক্ষা দিতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকার একটি বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য মাসুদকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ও উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখান।
মাসুদের বরাত দিয়ে র্যাব কর্মকর্তা জানান, পরিকল্পনা অনুযায়ী হারুন অর রশিদ তাকে অগ্রিম ৭০ হাজার টাকা দেন এবং কাজ সম্পাদনের পর তাকে আর ড্রাইভিং করতে হবে না এবং উন্নত জীবনযাপন করার সব ব্যবস্থা করে দেবেন বলে আশ্বাস দেন। গত ১৫ আগস্ট রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় গ্রেফতার মাসুদ তার সহযোগী হাফিজ, পনু, রাজু, সাব্বির, সাইফুল ও শান্তকে পরিকল্পনার কথা জানান এবং সবার মধ্যে ওই টাকা বণ্টন করে দেন। তারা রাজধানীর বেইলি রোড এলাকা থেকে ভুক্তভোগীকে অপহরণের সিদ্ধান্ত নেন। ভুক্তভোগীর বর্তমান গাড়ি চালকের সঙ্গে গ্রেফতার হাফিজের সুসম্পর্ক থাকায় ভুক্তভোগীর অবস্থান গাড়ি চালক থেকে জেনে মাসুদকে জানান।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, গত ১৭ আগস্ট রাত আটটায় তারা রাজধানীর বেইলি রোড এলাকায় অবস্থান নেন। ভুক্তভোগী রাত সোয়া আটটায় রাজধানীর মগবাজার থেকে নিজ গাড়িযোগে বেইলি রোড এলাকায় পৌঁছালে তারা পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী একটি মোটরসাইকেল ও একটি রিকশা দিয়ে ভুক্তভোগীর গাড়ির গতিরোধ করেন। এসময় ভুক্তভোগীর ড্রাইভার মোটরসাইকেল ও রিকশা সরানোর জন্য নামলে তাকে মারধর করেন এবং মাসুদ ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। এসময় গ্রেফতার পনুসহ অন্যান্য সহযোগীরা গাড়িতে উঠে বসে ভুক্তভোগীকে জোরপূর্বক অপহরণ করে হাতিরঝিলের দিকে নিয়ে যান। অপহরণের বিষয়টি ভুক্তভোগীর প্রথম স্বামীকে জানান। তখন ভুক্তভোগীর প্রথম স্বামী তাদের হাতিরঝিলে একটি বাসার ঠিকানা বলে দেন এবং তাকে সেখানে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা ওই বাসার মেইন গেইট বন্ধ পাওয়ায় ভুক্তভোগীকে নিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গাড়িতে করে ঘুরে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন।
পরে আনুমানিক রাত ১২টায় কাঁচপুর এলাকায় গ্রেফতার মাসুদের পরিচিত একটি গ্যারেজে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ভুক্তভোগীর কাছে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন এবং তার কাছে থাকা নগদ দেড় লাখ টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেন বলে ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন। পরে তাকে নিয়ে অপহরণকারীরা ১৮ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর মাদারটেক এলাকায় যান এবং জুমার নামাজ পর্যন্ত অবস্থান করেন। এ সময় গ্রেফতার মাসুদ ভুক্তভোগীর প্রথম স্বামীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি তাদের জুমার নামাজের পর সেখানে নিয়ে যেতে বলেন। পরে দুপুরে খাবারের সময় হলে মাসুদ, রাজু ও সাব্বির খাবার আনতে যান এবং পনু, সাইফুল ও শান্ত গাড়ি বাইরে পাহারায় থাকেন। এসময় সুযোগ বুঝে ভুক্তভোগী বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করলে স্থানীয় লোকজন ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করে সাইফুল, সাব্বির ও রাজুকে আটক করে এবং গ্রেফতার মাসুদ, পনু ও শান্ত কৌশলে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান। পরে পুলিশ এসে ভুক্তভোগীকে হেফাজতে নেয় এবং সাইফুল, সাব্বির ও রাজুকে গ্রেফতার করে তাদের কাছ থেকে ভুক্তভোগীর ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করে।
গ্রেফতার মাসুদ গত ২৫ বছর ধরে গাড়ি চালান। তিনি ইতঃপূর্বে বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের ভারী যানবাহন চালাতেন। বাস চালানোর সময় একটি সড়ক দুর্ঘটনায় কয়েকজনের নিহতের ঘটনায় তার নামে মামলা হলে তার ভারী যান চালানোর লাইসেন্সটি বাতিল হয়। এছাড়া তিনি গাড়ি চুরিসহ এলাকায় বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে জানা যায়। ওই ঘটনার পর তিনি রাজধানীর বাবুবাজার এলাকায় তার এক বন্ধুর বাসায় এবং গাজীপুর শ্রীপুর এলাকায় তার এক আত্মীয়ের বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন। সেখান থেকেই র্যাব তাকে গ্রেফতার করে।
গ্রেফতার পনু পেশায় একজন সিএনজি চালক। একই এলাকায় বসবাস করার কারণে মাসুদের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। ওই অপহরণের ঘটনায় মাসুদ তাকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা অগ্রিম দেন।
গ্রেফতার হাফিজ দূরপাল্লার বাস চালাতেন। ২০২২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সিলেট যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনার ফলে তার চাকরি চলে যায়। একই পেশা এবং একই এলাকায় বসবাসের কারণে মাসুদের সাথে তার সুসম্পর্ক ছিল। অপহরণের ঘটনায় মাসুদ তাকে পাঁচ হাজার টাকা অগ্রিম দেন।