শুধুমাত্র নামের মিল থাকায় পুলিশের গাফিলতিতে জেল খাটতে হয়েছে নিরাপরাধ লিটনকে। ১২ দিন জেল খাটার পর আদালতের আদেশে মঙ্গলবার (২০ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান তিনি। মামলার মূল আসামির সঙ্গে বাবার নাম, নিজের নামের মিল ও একই ইউনিয়নের হওয়ায় অনিচ্ছাকৃত এই ভুল হয়েছে বলে দাবি পুলিশের। তবে ভুক্তভোগী লিটনের দাবি, বারবার পুলিশকে বিষয়টি বলা হলেও তা আমলে না নিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
ভুক্তভোগী লিটন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানার বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ভায়েরখীল আশ্রয়ণ প্রকল্পের মো. এসহাকের ছেলে। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশের গাফিলতির কারণে বিনাদোষে ১২ দিন জেল খাটতে হয়েছে তাকে। মামলার মূল আসামি লিটন একই ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মিয়াজিপাড়া এলাকার মো. এসহাকের ছেলে।
সীতাকুণ্ড থানা সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের ১০ জুন রাতে উপজেলার কুমিরা ইউনিয়নের কাজীপাড়া এলাকায় ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ছয় জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওইদিন প্রকৃত আসামি লিটনকেও গ্রেফতার করা হয়। পরদিন গ্রেফতার ছয় জনসহ অজ্ঞাত আরও পাঁচ থেকে ছয় জনকে আসামি করে সীতাকুণ্ড থানায় মামলা করেন তৎকালীন এসআই মো. ইকবাল হোসেন। এরপর ওই মামলায় জামিনে বেরিয়ে পলাতক হন আসল অপরাধী লিটন। পরে ওই মামলার রায়ে আদালত লিটনকে এক বছরের সাজা দেন। তার বিরুদ্ধে জারি করেন গ্রেফতারি পরোয়ানা।
জানা গেছে, ডাকাতির প্রস্তুতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামির সঙ্গে নাম ও বাবার নামে মিল থাকায় নিরাপরাধ লিটনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু মায়ের নাম, বয়স ও ঠিকানা ছিল ভিন্ন। লিটনের বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বাড়বকুণ্ড ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ভায়েরখীল এলাকায় আশ্রয়ণ প্রকল্পে। সীতাকুণ্ডের শুকলালহাট বাজারে রাব্বি মেটাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ নামে একটি দোকান চালান লিটন, যেখানে স্টিলের আলমারি বিক্রি করা হয়। কিন্তু মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকা লিটনের বাড়ি একই ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মিয়াজিপাড়া এলাকায়। দুজনের বাড়ির দূরত্ব তিন কিলোমিটারের বেশি। তবে দুজনেরই বাবার নাম মো. এসহাক, যারা ভিন্ন ব্যক্তি।
কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের কারাফটকে কথা হয় ভুক্তভোগী লিটনের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, সীতাকুণ্ডের শুকলালহাট বাজারে আমার একটি দোকান আছে। নাম রাব্বি মেটাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ। ৯ ডিসেম্বর থানা থেকে একজন অফিসার পরিচয় দিয়ে ফোন করেন। একটি আলমারির রং করতে হবে উল্লেখ করে আমাকে থানায় যেতে বলেন তিনি। যেহেতু থানা থেকে ফোন করেছেন এবং থানার কাজ, সেজন্য আমি যত দ্রুত সম্ভব থানায় যাই। থানায় যাওয়ার পর পুলিশ বলে আমার নামে নাকি গ্রেফতারি ওয়ারেন্ট আছে। আমি অনেকবার বলেছি, আমার নামে কোনো মামলা নেই। আমি কোনো অপরাধে জড়িত নই।
তিনি বলেন, আমাকে গ্রেফতার করার বিষয়টি জানার পর আমার আত্মীয়-স্বজন ও পরিবারের লোকজন থানায় গিয়ে অনেক কাকুতি মিনতি করেন। তারাও বলেন আমার নামে কোনো মামলা নেই। ফলে গ্রেফতার ওয়ারেন্ট থাকার কথা নয়। বারবার আমরা পুলিশকে বিষয়টি আরও খতিয়ে দেখার অনুরোধ করি। কিন্তু পুলিশ কোনো কথা শোনেনি। আরেকজনের মামলায় আমাকে গ্রেফতার দেখিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে। এখন আমি ১২ দিন জেল খেটেছি। অপরাধ না করে পুলিশের গাফিলতির কারণে আমি কারাভোগ করেছি। এতে আমার ব্যবসার ক্ষতি হয়েছে। মান-সম্মানের ক্ষতি হয়েছে। আমি এর বিচার চাই।
এদিকে, গত ৯ ডিসেম্বর গ্রেফতার এবং কারাগারে যাওয়ার পর স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা আসল ঘটনা তুলে ধরে প্রতিবেদন করেন। এরপর পত্রিকার প্রতিবেদনকে সামনে এনে আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে জামিনের আবেদন করা হয়। আদালত গত ১৫ ডিসেম্বর ঘটনার সত্যতা যাচাই করে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে সীতাকুণ্ড থানাকে নির্দেশ দেন। সোমবার (১৯ ডিসেম্বর) পুলিশ প্রতিবেদন জমা দিয়ে নিজেদের ভুল স্বীকার করে আদালত থেকে মার্জনা চায়। একই সঙ্গে আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে গ্রেফতার হওয়া লিটন আসল অপরাধী লিটন নয় বলে উল্লেখ করা হয়। এরপর আদালত লিটনকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দিয়ে মুক্তির আদেশ দেন।
চট্টগ্রাম চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বেঞ্চ সহকারী মো. জয়নাল বলেন, সীতাকুণ্ড থানা পুলিশের প্রতিবেদন পাওয়ার পর সোমবার আদালত কারাগারে আটক লিটনকে মুক্তির আদেশ দিয়েছেন। পাশাপাশি প্রকৃত আসামিকে গ্রেফতারের জন্য নতুন করে পরোয়ানা জারি করেন।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ডেপুটি জেলার মনির হোসেন বলেন, মঙ্গলবার সকালে আদালতে থেকে বেইল বন্ড (জামিননামা) আসার পর যাচাই-বাছাই করে লিটনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফায়েল আহমেদ বলেন, নাম, বাবার নাম ও ঠিকানা এক (একই ইউনিয়নে) হওয়াতে একজনের পরিবর্তে আরেকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। এটি অনিচ্ছাকৃত ভুল ছিল। আমরা বিষয়টি জানার পর আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছি। আদালত আমাদের প্রতিবেদন আমলে নিয়ে লিটনকে মামলার দায়মুক্তি দিয়েছেন।