করোনা মহামারি
গণহারে করোনার টিকাদান কর্মসূচি শুরু করার শক্ত অবস্থানের মধ্য দিয়ে বাইডেন তাঁর শাসনামল শুরু করেছিলেন। তাঁর এই অবস্থান ছিল পূর্বসূরি ট্রাম্পের এ–সংক্রান্ত নীতির বিপরীত। কেননা, এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের অবস্থান ছিল বিভ্রান্তিকর। মহামারির ভয়াবহতাকে খাটো করে দেখার অভিযোগ ছিল ট্রাম্পের বিরুদ্ধে। করোনা মোকাবিলার বদলে ভাইরাসটির উৎপত্তি নিয়ে চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্বেও জড়ান তিনি। যদিও করোনার টিকা তৈরির দ্রুত অগ্রগতির বিষয়টি ট্রাম্প দেখভাল করেছিলেন।
২০২১ সালের ৪ জুলাই বাইডেন করোনাভাইরাসকে পরাস্ত করার ঘোষণা দেন। ওই বছরের গ্রীষ্মকালে ফের করোনার অতি সংক্রামক ধরন ডেলটার আঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বসন্তের মধ্যে সংক্রমণের নিম্নমুখী প্রবণতা বদলে যায়। ডিসেম্বরে ফের শুরু হয় অমিক্রন ধরনের প্রকোপ। ফলে বাইডেনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
বাইডেন ক্ষমতায় আসার শুরুতে তাঁর নেওয়া কোভিড-সংক্রান্ত নীতিতে ৬৯ শতাংশ আমেরিকানের সমর্থন ছিল। এখন সেটা দাঁড়িয়েছে ৪৬ শতাংশে। যুক্তরাষ্ট্রে রক্ষণশীল বলে পরিচিত এলাকাগুলোতে বাইডেন প্রশাসন টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা করে। তাঁর প্রশাসনের নেওয়া এই অবস্থান রাজনৈতিক বিরোধ উসকে দেয়। বড় ধরনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোতে টিকা বাধ্যতামূলক করতে তাঁর নেওয়া পদক্ষেপ গত বৃহস্পতিবার দেশটির সুপ্রিম কোর্ট আটকে দিয়েছেন।
অর্থনীতির পুনরুদ্ধার
আমেরিকা উদ্ধার পরিকল্পনা নামে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের একটি প্রণোদনা তহবিল পাসের কৃতিত্ব অবশ্য বাইডেন প্রশাসনের। করোনাভাইরাস মহামারির ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা ছাড়াও বেকারত্ব ঠেকানো ও মন্দার মুখে পড়া দেশটির অর্থনীতি উদ্ধারে পাস হয়েছিল এ প্রণোদনা তহবিল। বাইডেন ১ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলারের বিশাল একটি অবকাঠামো তহবিল পাস করেছেন। অবকাঠামোগত উন্নয়নের লক্ষ্যে এই বিল পাস করা হয়। তবে এই বিল পাস করানোর ক্ষেত্রে বিরোধী রিপাবলিকানদের সমর্থন পেয়েছেন জো বাইডেন। ট্রাম্পও এ রকম একটি অবকাঠামো বিল পাস করানোর জন্য চেষ্টা করেছেন। তবে চার বছরের শাসনামলে প্রতিশ্রুত বিলটি তিনি পাস করে যেতে ব্যর্থ হয়েছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও সমাজসেবা খাতে ব্যয়ের লক্ষ্যে বিল্ড ব্যাক বেটার নামে ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলারের একটি প্যাকেজ পাস করানোর চেষ্টা করেছিলেন বাইডেন। তবে বিলটি মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চকক্ষ সিনেটে গিয়ে আটকে যায়। বিরোধী দল রিপাবলিকান নয়, তাঁরই দল ডেমোক্র্যাটেরই সিনেটর জো মানচিন বিলটির বিরোধিতা করেন। বিলটির বিপক্ষে ভোট দেন তিনি। ১০০ সদস্যের সিনেটে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের সমান ৫০ জন করে সিনেটর আছেন। ফলে একজন ডেমোক্র্যাট সিনেটর বিলটির বিরোধিতা করার কারণে প্রেসিডেন্ট বাইডেন শেষ পর্যন্ত বিলটি পাস করতে ব্যর্থ হন।
২০২১ সালে মার্কিন পুঁজিবাজারের সূচক ও চাকরির সংখ্যা বৃদ্ধির অবশ্য রেকর্ড হয়েছে। বেকারত্বের সংখ্যা এখন নেমে ৩ দশমিক ৯ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে একই সময়ে বাইডেনের শাসনামলে মূল্যস্ফীতি আশ্চর্যজনকভাবে অনেকটা বেড়ে যায়। বার্ষিক হিসাবে গত ডিসেম্বরে মূল্যস্ফীতি ছিল রেকর্ড ৭ শতাংশ। কয়েক মাস ধরে জো বাইডেনের অর্থনৈতিক উপদেষ্টারা দাবি করছেন যে এই মূল্যস্ফীতি হবে অল্প সময়ের জন্য। তবে মূল্যস্ফীতি রয়েই গেছে।
গণতন্ত্র ও সামাজিক পরিবর্তন
বাইডেন একজন প্রকৃত মধ্যপন্থী রাজনীতিক। তবে তাঁর দল ডেমোক্র্যাটে বামঘেঁষা একটি পক্ষ আছে। তাদের সন্তুষ্ট করার ক্ষেত্রে বাইডেন বেশ জটিলতার মুখেই পড়েন। এ ছাড়া কিছু ভোটার গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও তাঁকে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়, বিশেষ করে আফ্রিকান-আমেরিকানদের সন্তুষ্ট করার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। বাইডেন প্রায়ই আমেরিকানদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে লাগাম টানা ও পুলিশের নিষ্ঠুরতা ঠেকানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও এটা নিয়ে তেমন কিছুই করতে পারেননি। এ ছাড়া কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্য বন্ধে বাইডেনের ভোটাধিকার সংস্কারের উদ্যোগ দুই ডেমোক্র্যাট সিনেটরের বিরোধিতায় সিনেটে ভরাডুবির মুখ দেখেছে।
বড় কোনো ইস্যুর কথা বিবেচনায় নিলে বাইডেনের অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল দেশটির রাজনৈতিক বিভাজন সারিয়ে তোলা। এ ক্ষেত্রেও বাইডেন খুবই কম নম্বর পাবেন। শপথের সময় নেওয়া ভাষণে জো বাইডেন আমেরিকানদের মধ্যে ঐক্য আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন, অভিবাসীদের ওপর ঘৃণা-বিদ্বেষ দূর, সাংবাদিক ও গণসমাবেশে অন্য বিরোধীদের ওপর আক্রমণ বন্ধের চেষ্টা চালাবেন তিনি। কিন্তু এখনো ট্রাম্পের মতাদর্শের আধিপত্য চলছে পুরো রিপাবলিকান পার্টিতে এবং ধারণা করা হচ্ছে, ধনকুবের ট্রাম্প ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আবার লড়বেন। এদিকে বাইডেনকে তাঁর নিজের দলের বামপন্থী ঘাঁটির দিকে আরও টানা হচ্ছে। স্বতন্ত্রদের সমর্থনও হ্রাস পাচ্ছে।
‘আমেরিকা ইজ ব্যাক’
শপথ নেওয়ার প্রথম দিন বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন ‘আমেরিকা ইজ ব্যাক’। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অবশ্য এটা করেছেন তিনি। বাইডেন জলবায়ুসংক্রান্ত প্যারিস চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ফিরিয়ে এনেছেন এবং ইরানের পরমাণু সক্ষমতা নিয়েও বহুজাতিক আলোচনায় বসেছেন। ক্ষমতায় আসার পরই বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে পুরোনো ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইউরোপ, সামরিক জোট ন্যাটো ও এশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ওপর জোর দেন। অংশীদার হিসেবে মিত্রদের আশ্বস্ত করেছে ওয়াশিংটন। ট্রাম্প বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গেও দ্বন্দ্বে জড়িয়েছিলেন। জো বাইডেন অবশ্য পূর্বসূরি ট্রাম্পের এমন অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এ ক্ষেত্রে তাঁর প্রশাসন ছিল ইতিবাচক। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্থান ২০ বছরের একটি ব্যর্থ যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছে এবং এটা ছিল এমন কিছু, যা নিয়ে আগের প্রেসিডেন্টরা কেবল কথা বলেই গেছেন। তবে তাতে বাইডেনের শেষ রক্ষা হয়নি। আফগানিস্তান ছাড়ার সময় দেশটিতে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়, তা যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিতে প্রভাব ফেলেছে। মানবিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। আর সে দায় কিছুটা হলেও বাইডেনের ওপর বর্তায়।