জাপান থেকে ফিরে তুলেছিলেন একটি পাঁচতলা ভবন। নাম তার ‘জাপানি কটেজ’। যিনি এই কটেজ তুললেন এরপর থেকে তাঁর নামও বদলে গেল। আদতে তাঁর নাম আমিনুল ইসলাম ওরফে হান্নান। কিন্তু এখন এলাকার মানুষ তাঁকে চেনে ‘জাপানি হান্নান’ নামে। নিজের নাম বদলের এই প্রক্রিয়ায় তাঁর হাত হয়তো সামান্য। কিন্তু নিজের ইচ্ছামতো এলাকার নামটি বদলে দিতে তিনি করেছেন অনেক কিছু। রাজধানীর দক্ষিণখানের আইনুছবাগ নামের ওই এলাকাটির নামকরণ তিনি করতে চান ‘চাঁদনগর’। কেননা তিনি এসেছিলেন চাঁদপুর থেকে।
সেই চাঁদনগরে এই জাপানি হান্নানের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ এলাকার মানুষ। পুলিশের তথ্যমতে, দক্ষিণখান থানায় ২০১০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত হত্যা, চাঁদাবাজি ও অস্ত্র আইনে ১১টি মামলা, ১৩টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) এবং আদালতে একটি মামলা হয়েছে জাপানি হান্নানের নামে।
গত ২৪ মার্চ দক্ষিণখানের আইনুছবাগে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন রড-সিমেন্টের ব্যবসায়ী আবদুর রশীদ। অভিযোগ উঠেছে, জাপানি হান্নানের শটগানের গুলিতে তিনি নিহত হন। ওই ঘটনায় আমিনুল ও তাঁর ১৩ সহযোগীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। ওই মামলায় আমিনুলসহ আটজন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য ৫০-৬০ জন নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তুলেছেন আমিনুল। তাঁর অন্য সহযোগীরা এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পুলিশের উত্তর বিভাগের উপকমিশনার মো. শহিদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাপানি হান্নান’–এর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে এখনো নানা ধরনের অভিযোগ আসছে। আইনুছবাগের আধিপত্য ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল। এলাকায় কেউ কিছু করতে গেলেই তাঁকে চাঁদা দিতে হতো। রশীদ হত্যার পর পুলিশ তাঁর বাসায় অভিযান চালিয়ে একাধিক অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করেছে।
যেভাবে জাপানি হান্নানের উত্থান
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, চাঁদপুরের মতলব উপজেলার আমিরাবাদের বাসিন্দা হান্নান ২৫ বছর আগে আইনুছবাগে ৮ কাঠা জমি কিনে থাকতে শুরু করেন। তখন তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে মধ্যস্থতা করতেন। এরপর তিনি জাপানে যান। সেখান থেকে ২০০৮ সালে দেশে ফিরে ওই জমির ওপর ‘জাপানি কটেজ’ নামে পাঁচতলা একটি ভবন নির্মাণ করেন। তখন থেকেই তিনি পরিচিতি পান ‘জাপানি হান্নান’ হিসেবে। বিমানবন্দর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সোহেল রেজা বলেন, ২০১০ সালের দিকে দক্ষিণখান থানা যুবলীগের বহিষ্কৃত এক নেতার সংস্পর্শে হান্নানের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের উত্থান ঘটে। এর পেছনে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক এক শীর্ষ নেতা ও মন্ত্রী এবং সরকারের উচ্চপদস্থ এক ব্যক্তির প্রশ্রয় ছিল। তবে হান্নানের আওয়ামী লীগে কোনো পদপদবি ছিল না।
এলাকার নাম পরিবর্তন
বাড়ি চাঁদপুরের সঙ্গে মিল রেখে হান্নান আইনুছবাগ এলাকার নাম পরিবর্তন করতে চান ‘চাঁদনগর’। বাসাবাড়ি ও দোকানপাটের সাইনবোর্ডে চাঁদনগর লেখাতে বাধ্য করতেন তিনি। তিনি স্থানীয় চান মিয়া মসজিদেরও নাম পাল্টে রাখেন চাঁদনগর জামে মসজিদ। এ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দার মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। হান্নান একে একে গড়ে তোলেন বেসরকারি সংস্থা ম্যাক্স সোশ্যাল এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন, ঢাকার বৃহত্তর কুমিল্লা সোসাইটি। তাঁর বাড়ির সামনে আছে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানার। তিনি এসব সংগঠনের বিভিন্ন পদে আছেন। এর মধ্যে তিনি নিজেকে জাপান-বাংলাদেশ মানবাধিকার সংস্থার মহাসচিব ও বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দাবি করতেন। ২০১৬ সালে এমএলএম নামের প্রতিষ্ঠান খুলে তিনি মানুষের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি চাঁদনগর কল্যাণ সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করে তিনি এর প্রধান উপদেষ্টা হন। আইনুছবাগে অন্তত ৫০০টি বাড়ি আছে। ১০ বছর ধরে ম্যাক্স সোশ্যাল এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের ব্যানারে ‘জাপানি হান্নান’ প্রতিটি ঘর থেকে ১৫০ টাকা চাঁদা নিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ করছেন বলে অভিযোগ।
আইনুছবাগের বাসিন্দা মাহমুদুল হাসান বলেন, হান্নান তাঁর বাহিনীর সশস্ত্র মহড়ায় এলাকাবাসীকে তটস্থ রাখতেন। সামনে ও পেছনে মোটরসাইকেলের পাহারায় কালো কাচঘেরা ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডযুক্ত গাড়িতে চলতেন। ২০১০ সালে বিমানবন্দরের উল্টো দিকের হাজি ক্যাম্প থেকে আইনুছবাগ পর্যন্ত অননুমোদিত অটোরিকশা সার্ভিস চালু করেন।
এই রুটে অন্তত ৫০টির মতো অটোরিকশা চলছে। প্রতিটি অটোরিকশা থেকে মাসে দুই হাজার টাকা করে চাঁদা তোলে হান্নানের লোকজন। এ ছাড়া এলাকায় কেউ বাড়ি নির্মাণ শুরু করলে ১ থেকে ২০ লাখ, প্রতিটি বিদ্যুৎ–সংযোগের জন্য ২০ হাজার, ওয়াসার পাম্পকে নিজের পাম্প দাবি করে প্রতি সংযোগ থেকে ৩০ হাজার টাকা চাঁদা নিতেন। আইনুছবাগের ১৩০ বাসিন্দা ২০১৫ ও ২০১৯ সালে হান্নানের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে রক্ষা পেতে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার, ডিএমপির উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার, র্যাবের কাছে একাধিক আবেদন করেন। কিন্তু এত দিন তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে পুলিশের উত্তরা বিভাগের উপকমিশনার শহিদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, আগের পুলিশ কী করেছে, তা তিনি জানেন না। তবে তিনি কয়েক মাস আগে যোগ দিয়েছেন। রশীদ হত্যাকাণ্ডের পর ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে সাতটি মামলা নিয়েছেন। এসব মামলা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।