‘ঋণগ্রহীতার কাছে ব্যাংকারের প্রশ্ন—টাকা ফেরত দেবেন, নাকি অন্য মতলব আছে? ফেরত দিলে এক রকম, না দিলে অন্যরকম।’—এটি একসময়কার ব্যাংকিং খাতের প্রচলিত গল্প। তারপর নানা সংস্কার, নানা কিছু। সরকারি ব্যাংকের বদলে বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব। এখন অর্ধশতর বেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকই রয়েছে। সিংহ ভাগই বেসরকারি। সংখ্যায় ৪৩টি। কিন্তু শৃঙ্খলা কি ফিরেছে, প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে। শুরুর গল্পের রূপান্তর ঘটেছে, কিন্তু বাস্তবতা খুব বদলায়নি—এমনটি মনে করেন সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলোও।
পরিস্থিতি এমন যে, বেসরকারি ব্যাংকে কোনো কোনো পরিচালককে টাকা না দিলে ঋণ পাওয়া যায় না। করোনাকালীন প্রণোদনা ইস্যুতে যেমন ‘খাতিরের’ কিংবা ‘প্রভাবশালী’রাই প্রাধান্য পেয়েছে। তেমনি প্রণোদনার ঋণ পেতে ঘুষ দাবির তথ্যও উঠে এসেছে বিভিন্ন গবেষণায়। প্রণোদনার ঋণ-সাশ্রয়ী, তাই হয়তো বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। কিন্তু সাধারণ সময়েও ঋণ নিতে হলে পরিচালকদের খুশি করতে হয়। ‘পরিচালকরা ঋণের টাকায় ভাগ চায়।’
বিষয়টি নিয়ে কোনো কোনো উদ্যোক্তা বলেছেন, ঋণ প্রস্তাব ব্যাংকের কাছে দেওয়ার পরই ব্যাংকাররা প্রস্তাব করেন পরিচালকদের টাকা দিতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরিচালক নিজেই টাকা দাবি করেন। সেটিও কৌশলে। নিজেদের নাম প্রকাশ করলে সমস্যা হতে পারে, সে চিন্তাও উদ্যোক্তাদের আছে।
মৌখিক এই প্রস্তাবে সম্মত হলেই ব্যাংকাররা ঋণ প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং তা অনুমোদিত হয়। ঋণ অনুমোদনের পর যথারীতি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে যায় পরিচালক বা তার বাহক। কিন্তু বছরের পর বছর পার হলেও তা ফেরত দেওয়ার তাগিদ থাকে না। অথচ ঐ অঙ্কের ঋণের সুদসহই কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে গ্রাহককে। একপর্যায়ে গ্রাহকের ব্যবসা খারাপ হলে, কিস্তি চালাতে অসমর্থ হলে খেলাপি হওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এই বাড়তি বোঝা একজন উদ্যোক্তাকে ঋণখেলাপিতে পরিণত করে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, এ ধরনের অভিযোগ অহরহ। এক ব্যাংক পরিচালক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার বিষয়টিত আছেই। কিন্তু গ্রাহকের কাছ থেকে ধার নেওয়ার নামে অর্থ আত্মসাত্ করছে। বাড়তি ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে ভালো কোনো গ্রাহকের কাঁধে। ক্ষেত্র বিশেষে ২-৩ কোটি থেকে শুরু করে ১০০ কোটি বা তার বেশি টাকা এভাবে গ্রাহকপ্রতি নিয়ে নিচ্ছে কোনো কোনো চেয়ারম্যান, পরিচালক।
এই সূত্র মতে, এমনিতেই ব্যাংকিং খাতে সরল সুদ চালু না থাকায় ঋণগ্রহীতারা বিপাকে রয়েছে। সুদের ওপর সুদ, দণ্ডসুদ দিয়ে যে পরিমাণ টাকা ব্যাংক থেকে নিয়েছে, তারচেয়ে বহুগুণ বেশি শোধ করে দিলেও আসল কমছে না। বরং কোনো কারণে কিস্তি খেলাপি হলেই দণ্ডসুদ আরোপের মাধ্যমে আরো জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আষ্টেপৃষ্টে আটকে যায় গ্রাহক। রুগ্ণ হয়ে যায় শিল্পোদ্যোগ। একপর্যায়ে ব্যাংকও আটকে যায়। যা সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক।