দেশের উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নে কমছে বৈদেশিক অর্থের দাপট। একসময় মূল উন্নয়ন বাজেটের বেশির ভাগই ছিল বৈদেশিক ঋণ বা অনুদাননির্ভর। সেই সময় উন্নয়ন সহযোগীদের নানারকম প্রেসক্রিপশন বা পরামর্শ মানা ছিল বাধ্যতামূলক। কিন্তু ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে। কারণ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে সরকারের ব্যয়ের সক্ষমতাও। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র। সেখানে বলা হয়েছে-প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈদেশিক নির্ভরতা হ্রাস পেয়েছে। এ প্রবণতা অভ্যন্তরীণ সম্পদের শক্তিশালী অবস্থান চিহ্নিত করে।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এটা ঠিক যে একসময় বৈদেশিক অর্থায়ন না পেলে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হলেও সেটি নেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কিন্তু এখন সেই অবস্থার পরিবর্তন এসেছে। এখন নিজেদের অর্থে বৈদেশিক ঋণ ছাড়াই প্রকল্প নেওয়ার সক্ষমতা অর্জন হয়েছে। এটা অবশ্যই ইতিবাচক দিক। কিন্তু তাই বলে বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন নেই, এটা বলা যাবে না। কেননা বিদেশি ঋণের প্রকল্প হলে ভালো সংস্থাগুলো তদারকিও করে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়নে একটা জবাবদিহি রক্ষা হয়। এছাড়া সরকার যদি উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেই সব ঋণ নিয়ে নেয়, তাহলে ব্যক্তি খাত ঋণ পাবে না। তাই এটাকে অতিসরলীকরণ করা যাবে না।
আইএমইডির সাবেক সচিব আবুল মনসুর মো. ফয়জুল্লাহ বলেন, এটা আমাদের দেশীয় সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ। এখন দেশীয় অর্থেই প্রকল্পের বাস্তবায়ন বাড়ছে। সেক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ প্রকল্প আমাদের টাকায় করা হচ্ছে। একসময় এ ধরনের প্রকল্প হাতে নেওয়ার কথা চিন্তাই করা যেত না। এছাড়া যত বেশি বৈদেশিক ঋণনির্ভরতা কমবে, ততই ভালো। কেননা এই ঋণ সুদসহ পরিশোধ করতে হয় ডলারে। ফলে রিপেমেন্টে (পরিশোধ) যদি কম করতে হয়, তখন আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। এটাকে আমি ইতিবাচক দেখছি।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দুটি উৎস হতে অর্থায়নের জোগান দেওয়া হয়। একটি অভ্যন্তরীণ, অন্যটি প্রকল্প সাহায্য হিসাবে প্রাপ্ত ঋণ বা অনুদান (খাদ্য সহায়তা, বাজেট সহায়তা, পণ্য সহায়তা, বিশেষ উন্নয়ন সহায়তা, ঋণ বা পলিসি ঋণ)। ধীরে ধীরে বৈদেশিক ঋণ বা সহায়তা কমে আসছে। বিগত বছরগুলোয় ধারাবাহিকভাবে এ অবস্থা দেখা যাচ্ছে।
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত কয়েক বছরের সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরের মোট সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) ছিল ২ লাখ ৯ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে দেশীয় অর্থায়ন ছিল ১ লাখ ৩৪ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা বা ৬৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ। বৈদেশিক অর্থায়ন ধরা হয় ৬৩ হাজার কোটি টাকা, ৩০ দশমিক ১০ শতাংশ। এর আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরের আরএডিপিতে মোট বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ১ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ধরা হয় ১ লাখ ৩৯ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা বা ৬৯ দশমিক ১৮ শতাংশ। বৈদেশিক সহায়তা থেকে বরাদ্দ ছিল ৬২ হাজার কোটি টাকা বা ৩০ দশমিক ৮২ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের আরএডিপিতে মোট বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১ লাখ ২৫ হাজার ৬১৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা বা ৭১ দশমিক ১২ শতাংশ। বৈদেশিক অর্থায়ন ছিল ৫১ হাজার কোটি টাকা, যা ২৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
এছাড়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ৫৭ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিলের ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বা ৬৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ। বৈদেশিক সহায়তার বরাদ্দ ছিল ৫২ হাজার ৫০ কোটি টাকা বা ৩৩ দশমিক ০৩ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের আরএডিপি বরাদ্দ ছিল ১ লাখ ১৯ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৮৩ হাজার ৪৯৯ কোটি ২৭ লাখ টাকা বা ৬৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। বৈদেশিক অর্থায়ন ছিল ৩৫ হাজার ৭৯৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা বা ৩৩ দশমিক ০১ শতাংশ।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী শফিকুল আযম বলেন, আমাদের পলিসিই হচ্ছে দিনে দিনে বৈদেশিক ঋণনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসা। সেক্ষেত্রে দেশে জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) আকার যেহেতু বাড়ছে, সেহেতু দেশীয় অর্থায়নের বরাদ্দ বাড়াটাই স্বাভাবিক। এখন আমাদের দরকষাকষির সামর্থ্য বেড়েছে। আগে তো কথাই বলা যেত না।
তিনি আরও বলেন, সহজ শর্তে যেসব উৎস থেকে বৈদেশিক ঋণ পাওয়ার কথা, সেগুলো থেকে পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের উচিত একটা ভারসাম্য পরিস্থিতি তৈরি করা। কেননা পুরো উন্নয়ন বাজেটই যদি দেশীয় অর্থে করা হয়, সেটি খুব বেশি ভালো দিক নয়। কিছু বৈদেশিক অর্থায়ন থাকতেই হবে। এসডিজি বাস্তবায়নে যে পরিমাণ বৈদেশিক অর্থায়ন দরকার, সেটি পাওয়া জরুরি। এছাড়া বৈদেশিক ঋণের সুদের হারও কম। এক্ষেত্রে যা জরুরি, তা হচ্ছে বৈদেশিক ঋণ নিয়ে উৎপাদনশীল খাতের প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় করতে হবে।