ঘরোয়া কর্মসূচি থেকে বের হয়ে এখন নিয়মিত রাজপথে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে বিএনপি। অন্যদিকে বিএনপির কর্মসূচির দিনে শান্তি সমাবেশের নামে নিয়মিত মাঠে থাকছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে এতদিন শান্তিপূর্ণভাবে সবকিছু চললেও ক্রমেই মারমুখী অবস্থানে যাচ্ছে দুই দল। ফলে বাড়ছে সংঘাত-সংঘর্ষ। এতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে রাজপথ। পাশাপাশি সময়ের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশও কর্মসূচিতে বাধা দিচ্ছে এমন অভিযোগ বাড়ছে বিএনপির তরফ থেকে। ফলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সাত মাসের মতো সময় বাকি থাকতেই এমন পরিস্থিতিতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে সাধারণ মানুষের মাঝে।
দলীয় সূত্র বলছে- আগামী নির্বাচন পর্যন্ত রাজপথে নিজেদের শক্ত অবস্থান বজায় রাখবে আওয়ামী লীগ। সঙ্গে রাজপথের আন্দোলনে থাকবে বিএনপিও। বাধা আসলেও এবার নেতাকর্মীরা পিছু হটবে না। ফলে সামনের দিনগুলোতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে এমন আশঙ্কা সর্বত্র।
অবশ্য, সরকার ও রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির হাইকমান্ডের বক্তৃতা-বিবৃতিতে আপাতত আলোচনার সম্ভাবনা ক্ষীণ। যদিও দুই দলের শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ পর্দার আড়ালে আলোচনায় বসতে চান- এমন গুঞ্জনও আছে রাজনৈতিক অঙ্গনের ভেতরে-বাইরে।
রমজানের ঈদের পর থেকে এখন পর্যন্ত বিএনপি কেন্দ্রীয় ও তৃণমূলে যেসব কর্মসূচি পালন করেছে তাতে লোক সমাগমও হচ্ছে বেশ। কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতির কারণে কর্মীরাও উৎসাহ নিয়ে মাঠে নামছেন। এসব কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে এরই মধ্যে খুলনা, পটুয়াখালীসহ একাধিক জেলায় বিএনপি-আওয়ামী লীগ ও পুলিশের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষও হয়েছে।
গত কয়েকদিনের কর্মসূচি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বিএনপি শক্তভাবে মাঠে থাকার চেষ্টা করছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে নির্দলীয় সরকারের দাবি মানাতে বাধ্য করতে সামনে হরতালসহ কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারিও দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মাঠে দাঁড়াতে না দেওয়ার ইঙ্গিতও মিলছে। দুই দলের নেতাকর্মীদের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে হার্ডলাইনে আছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও।
বিএনপির অভিযোগ, পুলিশ তালিকা করে নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নতুন করে মামলা দিচ্ছে। গ্রেফতার করছে। পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে বিএনপির কর্মসূচিতে হামলা করা হচ্ছে।
সবশেষ গতকাল মঙ্গলবার (২৩ মে) রাজধানীর সায়েন্সল্যাবে বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয়েছে। যেখানে বাস ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। এই ঘটনায় একাধিক মামলা হয়েছে। বিএনপির অনেককে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ।
বিএনপির তথ্য অনুযায়ী, গত ১৯ মে থেকে ২৪ মে পর্যন্ত গত ছয়দিনে সারাদেশে বিএনপির ৬৫০ জনেরও বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বুধবার (২৪ মে) এক সংবাদ সম্মেলনে রুহুল কবির রিজভী দাবি করেছেন, এই ছয়দিনে সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের নামে মামলা হয়েছে ১৪৮টি। এসব মামলায় প্রায় ৫ হাজারের অধিক নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়াও সারাদেশে বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি দলের হামলায় বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী আহত হয়েছেন এবং অনেকেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
এদিকে, হঠাৎ করে রাজনীতির মাঠ গরম হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘হত্যার হুমকি’ দিয়ে রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদের এক বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। এ নিয়ে এরই মধ্যে মামলাও হয়েছে। পাশাপাশি বিষয়টির প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে দেশব্যাপী নানা কর্মসূচিও পালন করা হয়েছে। দাবি উঠেছে- বিএনপি নেতাকে গ্রেফতারের।
বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে রাজশাহীতে বিএনপির কার্যালয়ে তালা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। নেতারা বলছেন, পুলিশ তালা লাগিয়ে দিয়েছে। যদিও পুলিশ তা অস্বীকার করছে।
অন্যদিকে, চাঁদের ওই বক্তব্যকে ‘অনিচ্ছাকৃত ভুল’ দাবি করে ক্ষমা চেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু। তার দাবি- চাঁদের বক্তব্যের সঙ্গে তার দলের কোনো সম্পর্ক নেই। চাঁদ আবেগের বশবর্তী হয়ে ভুল করেছে, তার জন্য আমি সবার কাছে ক্ষমা চাইছি।
তবে এমন বক্তব্যকে হালকাভাবে নিতে রাজি নন আওয়ামী লীগ নেতারা। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর হামলা হলে সমুচিত জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। একই সঙ্গে বিএনপির কর্মসূচির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি পদযাত্রার আড়ালে সহিংসতা ও অগ্নিসন্ত্রাসের প্রস্তুতি নিচ্ছে।’
আওয়ামী লীগের অন্য শীর্ষ নেতাদের পক্ষ থেকে বিএনপিকে রাজপথে সমুচিত জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হচ্ছে বারবার।
যদিও রাজধানীতে দলের কর্মসূচিতে হামলার জন্য আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলছেন রুহুল কবির রিজভী। তার ভাষ্য, ‘ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশেই পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ প্রতিরোধের নামে বিএনপির ওপর হামলা শুরু করেছে। বিএনপি এখনো ঠেকানো শুরু করেনি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে জনগণই উপযুক্ত জবাব দেবে।’
এ নিয়ে কথা হলে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘বিএনপি সংঘাতে বিশ্বাস করে না। কিন্তু সরকার আন্দোলন থামিয়ে দিতে কৌশল করবে। আমরাও কৌশল ঠিক করে এগিয়ে যাব। পিছনে ফেরার সুযোগ নেই। নেতাকর্মীরা রাজপথে থাকার ব্যাপারে ডিটারমাইন্ড।’
একই কথা জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘সরকার না চাইলে আন্দোলন হবে না। চাইলে হবে। শিগগিরই সেই আন্দোলনের ঘোষণা হবে। নির্দলীয় সরকারের দাবি মেনে নেওয়া ছাড়া আন্দোলন বন্ধ হবে না। রাজপথেই নেতাকর্মীরা দাবি আদায় করবে।’
সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘চারিদিকের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে- একটা যুদ্ধ ঘোষণা হয়েছে। এর পরিণতি কী হবে, তা আসলে বলা মুশকিল। এখন আসলে সংঘাতের দিকেই যাচ্ছে দেশ। আসলে একে-অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে যাওয়া কোনো কোনো সমাধান নয়। এতে আরও সমস্যা বাড়ে। সবার জন্য চরম অমঙ্গলকর।’
এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আলাপ-আলোচনা করে সমাধানের আহ্বান জানিয়ে সুজন সম্পাদক বলেন, ‘অন্যথায় পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। এমন হলে তা দেশের জন্য, নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য ভীতিকর হবে। তাই সময় থাকতেই শুভবুদ্ধির উদয় হতে হবে।’