ঈদের একদিন আগেই হঠাৎ বাজার থেকে ‘উধাও’ সয়াবিন তেল। ভোজ্যতেলের এমন সংকটে চরম বিপাকে পড়েছেন দোকানে তেল কিনতে আসা ক্রেতারা। রোববার (১ মে) রাজধানীর কারওয়ান বাজার, পলাশী কাঁচাবাজার, মিরপুর-১০, শেওড়াপাড়া, মহাখালী, বনানী, তেজকুনীপাড়াসহ কয়েকটি বাজার ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সয়াবিন তেল কিনতে এসেছেন একটি বেসরকারি অফিসের কর্মী আশিকুল ইসলাম। তবে কয়েক দোকান ঘুরেও তেল পাননি বলে জানান তিনি। শুধু আশিক নয়, তার মতো আরও অনেক ক্রেতা তেল কিনতে এসে ফিরে যাচ্ছেন। ঈদের আগের দিন বাজারে ভোজ্যতেলের এমন সংকটে চরম বিপাকে পড়েছেন সাধারণ ক্রেতারা।
খুচরা বিক্রেতারা বলছেন- তাদের কাছে সয়াবিন তেল নেই। কোম্পানিগুলো তেল সরবরাহ করছে না। যা দিচ্ছে, তাতেও শর্তজুড়ে দেওয়া হচ্ছে। চা-পাতা নিতে হবে, না-হলে তেল দেবেন না তারা। তবে তেল সরবরাহকারী কোম্পানি ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের দাবি, তেল সরবরাহে কোনো ঘাটতি নেই। তারা আগের মতোই সরবরাহ করছেন। খুচরা বিক্রেতারা তেল মজুত করায় বাজারে সংকট সৃষ্টি হচ্ছে।
পলাশী কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ী নোমান হোসেন বলেন, কোম্পানিগুলো প্রথম কয়েক দিন তেল দিয়েছে। এখন আর দিচ্ছে না। কোম্পানিগুলো তেল দিলেও শর্তজুড়ে দেয়। এক কার্টুন সয়াবিন তেল নিলে আট প্যাকেট চা-পাতা নিতে হবে। অনেক কোম্পানি বলে সয়াবিন তেল নিলে সঙ্গে সরিষার তেলও নিতে হবে। তেল নিতে হরেক রকম শর্ত।
ঢাকার বনানীর এক মুদি দোকানি বললেন, গত দুদিন ধরে সয়াবিন তেল কিনতে পারছি না। ফলে বিক্রি বন্ধ রয়েছে। সয়াবিন না পেয়ে কেউ কেউ রাইস ব্রান তেল কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ, কোম্পানিগুলো দুই লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলে দুই টাকা বাড়িয়ে ৩১৪ টাকা দরে বিক্রি করছে। এ ছাড়া তেল কিনলে চা-পাতা, সরিষার তেল, ফিরনি মিক্স, হালিম মিক্স, হলুদ, মরিচ, আটা-ময়দা, সুজি ও লবণ কেনা বাধ্যতামূলক করেছে।
কারওয়ান বাজারের তরিক ও সৈকত নামে দুই দোকানি বললেন, গত এক সপ্তাহ ধরে বোতলজাত সয়াবিন তেলেরসরবরাহ সঙ্কট চলছে। ডিলাররা তেল দিচ্ছে না তাদের। তাই তেল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন তারা। শেওড়াপাড়া বাজারের এক দোকানি নাজমুল বলেন, বাজারে সয়াবিন তেল নেই। ঈদের আগে এমন ভয়াবহ সংকট সত্যিই বেদনাদায়ক। দুই কার্টুনে ১৮ বোতল সয়াবিন তেল কিনলে ২৭০ টাকার চা পাতা কিনতে হচ্ছে। তারপরও সয়াবিন তেল নেই। ফলে অনেক পরিচিত ক্রেতা হারাতে হচ্ছে।
মহাখালী কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হোসেন বলেন, সয়াবিনের চাহিদা ২০ কার্টুন দিলে সরবরাহ করে পাঁচ কার্টুন। এরপর সঙ্গে হালিম মিক্স, ফিরনি মিক্স নিতে হবে। অপ্রচলিত পণ্য নিতে হবে। এসব শর্ত মানতে রাজি। তবুও সয়াবিন তেল পাচ্ছি না।
তেলের সরবরাহ না থাকায় খুচরা বাজারে প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. গোলাম মাওলা। তিনি বলেন, আমদানিকারকদের কাছ থেকে তেল এনে সরবরাহ করতে হয়। আমরা যদি তেল আনতে না পারি, তাহলে কীভাবে বাজারে দেবো? বিশ্ব বাজারে তেল নিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, এজন্য মজুতের প্রয়োজন আছে। তেল মজুত করতে না পারলে তেলের দাম আরও বাড়বে।
তবে তেল সরবরাহ করা কোম্পানিগুলোর দাবি- ঈদের পরে সয়াবিন তেলের দাম বাড়তে পারে, এ আশায় খুচরা বিক্রেতারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, বর্তমানে তেলের কোনো সংকট নেই। খুচরা বিক্রেতারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে। আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ছুটিও বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, মিল মালিকদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা সঠিকভাবে তেল সাপ্লাই দিচ্ছেন। খুচরা বিক্রেতাদের দোকানের সামনে সয়াবিন তেল নেই ঠিকই, তবে দোকানের পেছনে ঠিকই তেল মজুত করছেন তারা। আমরা অভিযান পরিচালনা করছি এবং এসব খুচরা বিক্রেতাদের ধরছি, জরিমানা করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদার ৮০ শতাংশের বেশি আমদানি করে পূরণ করা হয়। সাত থেকে আটটি প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত তেল আমদানি করে পরিশোধন করে বাজারে ছাড়ে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, এ বছর মার্চ ও এপ্রিল দুই মাসে সয়াবিন তেল আমদানি হয়েছে ৯২ হাজার টন, যা গত সাত বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। একই সময়ে (১ মার্চ-২৮ এপ্রিল) ১ লাখ ৩৭ হাজার টন সয়াবিন তেল বন্দরের কাস্টম বন্ডেড ট্যাংক টার্মিনাল থেকে খালাস করেছে কোম্পানিগুলো।