নির্বাচন কমিশনে স্থান পেতে পাঁচ জনের বিপরীতে নাম পাওয়া গেছে ৩২৯ জনের। অর্থাৎ প্রতিটি পদের বিপরীতে ৬৫ দশমিক ৮ জনের নাম জমা পড়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল দিয়েছে ১৩৬ জনের নাম। পেশাজীবীদের কাছ থেকে ৪০ জন, স্বীয় উদ্যোগে আবেদন করেছেন ৩৪ জন এবং ই-মেইলের মাধ্যমে ৯৯ জনের নাম দেওয়া হয়েছে সার্চ কমিটির কাছে।
শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) দুই ধাপে সার্চ কমিটি ২৫ বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সার্চ কমিটির চেয়ারম্যান আপিল বিভাগের বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের সভাপতিত্বে সুপ্রিম কোর্টের কনফারেন্স লাউঞ্জে এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই মতবিনিময় সভায়ও বেশ কিছু নামের প্রস্তাব করা হয়েছে। এদিকে আজ রবিবার বিকাল ৪টায় সার্চ কমিটি দ্বিতীয় দফায় দেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।
এদিকে সোমবার বর্তমান নির্বাচন কমিশনের শেষ কর্মদিবস। তবে এদিনই নতুন নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্ব নিতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নাই। বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ কে এম নূরুল হুদা বলেন, পূর্ববর্তী কমিশনের মেয়াদান্তের ১০ দিন পর আমরা দায়িত্ব নিয়েছিলাম। এক্ষেত্রে কোনো সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হবে না।
আজকের পত্রিকার সম্পাদক ও গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. গোলাম রহমান বলেন, যারা নির্বাচন কমিশনে থাকেন তাদের অনেক সময় সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি বেশি আনুগত্য থাকে। অতিভক্তি দেখান। এই অতিভক্তির বিষয়টি যেন তারা ভুলে যান। গণস্বাস্হ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, যত নাম আসছে সেগুলো প্রকাশ করুন। আমরা আগে পাঁচটা নাম দিয়েছিলাম। সাখাওয়াত প্রধান নির্বাচন কমিশনার, সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূইয়া, আমাদের প্রথম নারী বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এবং মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল। তাছাড়া আমি বলেছি, যেহেতু ১০টি নাম, সে কারণে আমি আরো তিনটা নাম বিবেচনায় নিতে বলেছি। তার মধ্যে একজন হলো প্রাক্তন আইন সচিব কাজী হাবিবুল আউয়াল।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যে নাম দিয়েছে সেগুলো প্রকাশ করার কথা বলেছি। বামপম্হি রাজনৈতিক দলগুলো যদি দেখি তাদের মতাদর্শের লোকজনের নাম দিয়েছে, জাতীয় পার্টি (জাপা) যদি দেখি তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল লোকদের নাম দিয়েছে তাহলে তো এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে যে রাজনৈতিক দলগুলো সুষ্ঠু নির্বাচন চায় না। অতএব নাম প্রকাশ করলে আমরা বুঝতে পারব রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশ্য কি? কীভাবে নির্বাচন কমিশনকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করা যায় সেটার ওপর আমরা সবাই মতামত দিয়েছি।
ইত্তেফাক সম্পাদক তাসমিমা হোসেন বলেন, সার্চ কমিটিকে আমি বলেছি যাদেরকেই নিয়োগ দেওয়া হোক না কেন সেই নামগুলো যেন আগেই গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। যাতে করে জনমত যাচাই হতে পারে। জনগণের কাছে কমিশনকে গ্রহণযোগ্য করতে পারেন এমন ব্যক্তিদেরই প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করা উচিত। জাগরণ সম্পাদক আবেদ খান বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ও সত্ মানুষকে নিয়োগের কথা বলেছি। চ্যানেল টুয়েন্টিফোরের ব্যবস্হাপনা পরিচালক এ কে আজাদ বলেন, এখন পর্যন্ত যাদের নাম এসেছে তাদের সবার নাম যেন গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয় সেই অনুরোধ সার্চ কমিটির কাছে রেখেছি।
যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন মানুষ প্রয়োজন। এমন মানুষ প্রয়োজন যিনি নির্লোভ থাকবেন। ভবিষ্যতে আবার কোনো পদে যাব এমন লোভ যার থাকবে না। ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, নির্বাচন কমিশনে কোনকালে সংখ্যালঘু বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব ছিল না। আমরা বলেছি গণমাধ্যম থেকে প্রতিনিধিত্ব নিতে। সিভিল সোসাইটিতে ভালো ভূমিকা আছে তাদেরকে নিতে।
একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু বলেন, আমরা বলেছি আপনারা যাদেরকে নির্বাচিত করবেন, কয়দিন আগেই তাদের নামটা মিডিয়ায় দেওয়ার জন্য। কেননা মিডিয়া যদি তাদের নামটা জানতে পারে, তাহলে তাদের সম্পর্কে গণমানুষের কোনো অভিযোগ থাকে কিংবা কোনো অতীত থাকে, যেটা পরে নির্বাচিত হয়ে গেলে একটা কেলেঙ্কারির কারণ না হয়। তারা এ ব্যাপারটি বিবেচনা করবেন বলেছেন।
জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, সত্ যোগ্যতাসম্পন্ন গুণগুলো তারা যেন বাছাইয়ের সময়ে গুরুত্ব দেয়। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন কমিশন গঠন হয়, সে ধরনের নাম যেন তারা প্রস্তাব করেন। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, অনুসন্ধান কমিটি যাদের মনোনয়ন করবেন তারা যেন স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি হয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, যারা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পাবেন তারা যেন কোনো সরকারের আমলে বিশেষ সুবিধাভোগী না হন। কোনো দলীয় সরকারের অধীনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে, চাকরির মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়ার মাধ্যমে, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের মাধ্যমে কোনো কোনো সরকার তার বিশ্বস্ত লোকদের সুবিধা দিয়ে থাকে, এ ধরনের ব্যক্তিরা যাতে সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে স্হান না পান।
সভা শেষে অনুসন্ধান কমিটির সাচিবিক দায়িত্বে থাকা মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে যোগ্য ব্যক্তি বাছাইয়ে রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠনসহ ব্যক্তি পর্যায়ে মোট ৩২৯ জনের নামের প্রস্তাব এসেছে। যেসব নাম পেয়েছি সেগুলো আজকের মধ্যে শর্টআউট হয়ে যাবে। তিনি বলেন, মতবিনিময় সভায় সবার মূল বক্তব্য হলো এমন একটা নির্বাচন কমিশন গঠন করা যাতে সবার আস্হাভাজন হয়। ভালো একটা নির্বাচন ব্যবস্হার জন্য তারা পদক্ষেপ নিতে পারেন। সেটাই মূল বক্তব্য ছিল। এগুলো সার্চ কমিটি সব নোট করেছে। আজ আরেকটি সভা রয়েছে বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে। ঐ সভা শেষে এসব প্রস্তাব নিয়ে সার্চ কমিটি কর্মপদ্ধতি ঠিক করবে। বিএনপিসহ যেসব দল নাম প্রস্তাব করেনি, তাদের কাছ থেকে নাম নেওয়ার জন্য আবার কোনো সুযোগ দেওয়া হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, আজ কমিটির মিটিংয়ের পর বোঝা যাবে।