দেশে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আরও এক বছর। ইতোমধ্যে বড় দলগুলোর মধ্যে হিসাব-নিকাশ শুরু হয়ে গেছে। ভোটের প্রক্রিয়া নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে টানাপোড়েন থাকলেও দুই দলই আগামী নির্বাচন নিয়ে নানা হিসাব কষছে। এই অবস্থায় ধর্মভিত্তিক ইসলামি দলগুলোর কদর বেড়েছে। দুই দলই তাদের নিজেদের পক্ষে টানার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
কওমি মাদরাসাভিত্তিক আলোচিত সংগঠন হেফাজতে ইসলাম দীর্ঘদিন নীরব থাকার পর আবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে। গতকাল শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) সংগঠনটি ঢাকায় কাজী বশির মিলনায়তনে ওলামা-মাশায়েখ সম্মেলন করে। ওইদিনই সংগঠনের একটি প্রতিনিধি দল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে গিয়ে দেখা করে। তারা কারাবন্দি নেতাকর্মীদের মুক্তিসহ বেশ কিছু দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী তাদের দাবিতে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন হেফাজত নেতারা।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের এক দিনের মাথায় রোববার (১৮ ডিসেম্বর) হেফাজতের বিলুপ্ত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী প্রায় ২০ মাস কারাভোগের পর মুক্তি লাভ করেছেন। এটাকে হেফাজত ইস্যুতে সরকারের নমনীয়তা হিসেবে দেখছেন অনেকেই। হেফাজত নেতারা জানিয়েছেন, মাওলানা মামুনুল হকসহ তাদের কারাবন্দি অন্য নেতারাও মুক্তি লাভ করবেন বলে আশা করছেন।
হেফাজত নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যখন সাক্ষাৎ করেন সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালও ছিলেন। তিনি রোববার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, তাদের দাবি-দাওয়া প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী তাদের সন্তুষ্ট করেছেন। তাদের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জানিয়েছেন তাদের দাবি-দাওয়া যেগুলো যৌক্তিক সেগুলো তিনি অবশ্যই দেখবেন, সেগুলো করে দেবেন আর যেগুলো একটু সময় লাগবে সেগুলো তিনি নজরে আনবেন।
সূত্র জানায়, হেফাজতে ইসলাম হঠকারী কোনো কর্মসূচি দেবে না, যা সরকারের বিরুদ্ধে যায়-এমন আশ্বাস দিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা। হেফাজতে ইসলামে নেতৃত্বের আমূল পরিবর্তন আসার পর সরকারও মনে করছে, তারা এই আশ্বাস বাস্তবায়ন করবে। ফলে হেফাজতের ব্যাপারে নমনীয় নীতি অবলম্বন করছে সরকার।
টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের জন্য আগামী নির্বাচনের বৈতরণী পার হওয়া কিছুটা কঠিন হবে। ইতোমধ্যে মাঠের রাজনীতিতে বিএনপির সরব হওয়া এবং বিদেশি কূটনীতিকদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ চাপে সেটা আঁচ করা গেছে। ফলে আওয়ামী লীগ চাচ্ছে, ইসলামপন্থীদের ভোট যেন কোনোভাবেই বিএনপির বাক্সে না যায়। এ কারণে ইসলামি শক্তিগুলোকে নিজেদের কাছে টেনে বিএনপি থেকে বিমুখ করাই সরকারের উদ্দেশ্য।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ইসলামি দলের এক নেতা জানান, আগামী নির্বাচনের আগে ইসলামি দলগুলো নিয়ে এক বা একাধিক জোট করার ভাবনা সক্রিয়। এক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকেও সহযোগিতা করা হবে। ইতোমধ্যে বিএনপি জোটে ছিল বা বিএনপির প্রতি দুর্বল এমন দলগুলোর সমন্বয়ে এই জোট করার পরিকল্পনা চলছে।
এদিকে বিএনপিও ইসলামি দলগুলোকে নিজেদের পক্ষে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নিজেদের জোটে থাকা কয়েকটি ইসলামি দল জোট ছাড়ার ঘোষণা দিলেও খণ্ডিতাংশ নিজেদের সঙ্গে রেখে দিয়ে বিএনপি প্রমাণ করতে চাচ্ছে, ইসলামি শক্তি তাদের সঙ্গে রয়েছে। যদিও ইসলামি দলগুলোর মধ্যে বিএনপির প্রতি আগের সেই টান নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইসলামি দলগুলোর কদর: কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনীতি বিশ্লেষক শেখ হাফিজুর রহমান জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘ভোট ও আন্দোলনের শক্তি বাড়াতে বড় দুই দলই ইসলামি দলগুলোকে কাছে টানে৷ এক্ষেত্রে কোনো আদর্শ কাজ করে না৷ কিন্তু বাস্তবতা হলো তারা ভোটে একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে৷ তাই ভোটের রাজনীতিতে কোনো আদর্শ থাকে না৷’
এই বিশ্লেষক বলেন, ‘হেফাজতের মতো সংগঠনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী যখন বৈঠক করে তখন তা আওয়ামী লীগের জন্য দুঃখজনক৷ তারা নারীনীতি বিরোধী৷ তার পাঠ্যপুস্তকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও হুমায়ুন আজাদের মতো সাহিত্যিকদের লেখা বিরোধী৷ তাদের দাবি মেনেও নেওয়া হয়৷ হেফাজত কোনো রাজনৈতিক দল না হলে বিভিন্ন দলে তাদের প্রভাব আছে৷ ভোটে তাদের প্রভাব আছে৷ তারা একটা বড় ফ্যাক্টর৷ সেই বিবেচনায় হয়তো হেফাজতকে কাছে রাখতে চাইছে আওয়ামী লীগ৷’
শেখ হাফিজুর রহমান বলেন, ‘অন্যদিকে জামায়াত আন্দোলন ও ভোট দুই দিকেই একটি ফ্যাক্টর৷ তারা কোনো জোটে গেলে তাদের ভোট বেড়ে যায়৷ তাই বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধী দলটিকে সবসময়ই সাথে রাখে৷ বিএনপির মধ্যেও এর বিরোধিতা আছে৷ তারপরও জামায়াত ছাড়ছে না বিএনপি৷ এর একটি ভিন্ন কারণও আছে৷ তাদের আন্তর্জাতিকসহ নানামুখী যোগাযোগকে বিএনপি তার পক্ষে কাজে লাগাতে চায়৷ যার ফলে জামায়াতকে ছাড়া বিএনপির পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে।’
ঢাবির এই শিক্ষক মনে করেন, ‘ধর্ম ভিত্তিক দলগুলোকে বাদ দিয়েও বড় দুই রাজনৈতিক দল নির্বাচন, আন্দোলনে ভালো করতে পারে৷ তার প্রমাণও আছে৷ কিন্তু এখন তারা যেভাবে জড়িয়ে পড়েছে তাতে ধর্মভিত্তিত দল ও সংগঠনগুলোকে তাদের পক্ষে আর উপেক্ষা করার সুযোগ নেই৷ তাদের প্রভাব দিন দিন আরও বাড়বে৷’
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নেহাল করিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘এখানে ক্ষমতায় যাওয়ার প্রতিযোগিতা হচ্ছে৷ নীতি, আদর্শ বলতে কিছু নেই৷ এর সঙ্গে গণতন্ত্র বা নাগরিকদের কল্যাণের কোনো সম্পর্ক নেই৷ তাই যে যেভাবে পারছে তাকে দলে টানাছে৷ ভোট বাড়াচ্ছে৷ শক্তি বাড়াচ্ছে৷ বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে হিসাব আছে যে ইসলামি দলগুলোর হাতে কত ভোট আছে৷ এখানে মসজিদ, মাদরাসাকেন্দ্রিক অনেক ভোট৷ সেই হিসাব করে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কাছে টানছে৷ তাই বিএনপির জন্য জামায়াত আর আওয়ামী লীগের জন্য হেফাজত অনিবার্য হয়ে উঠেছে৷’
নেহাল করিম বলেন, ‘ওই দলগুলোকে তারা যে খুব মর্যাদা দেয় তা নয়৷ স্বার্থ হাসিলের জন্য তাদের ছিটোফোঁটা দিয়ে কাছে রাখে। এই ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতির কারণে রাষ্ট্রের আদর্শিক অবস্থানও নষ্ট হচ্ছে৷ কোনো চরিত্র গড়ে উঠতে পারছে না৷ এথেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন সঠিক ও শক্তিশালী নেতৃত্ব৷ সেটার বড় অভাব বাংলাদেশে৷’
এই অধ্যাপক বলেন, ‘আর যারা এনিয়ে কথা বলবেন সেই বুদ্ধিজীবী শ্রেণিও কচ্ছপের মতো হয়ে গেছে৷ তারা বিপদ দেখলে মাথা ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলে৷ বুদ্ধিজীবীরা নগদজীবী হয়ে গেছেন৷ মাস্টাররা বিভিন্ন পদ পেয়ে যাচ্ছেন, তাতেই সব হয়ে যাচ্ছে৷’