গত দুই মৌসুম পুরান ঢাকার ইসলামপুরের কাপড়ের মার্কেটে তেমন বেচাকেনা ছিল না। তবে সংক্রমণ কমে আসায় এবার সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আশায় ছিলেন ব্যবসায়ীরা। ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে রোজা শুরুর ১০ থেকে ১৫ দিন আগে থেকে জমেও উঠেছিল বেচাকেনা। শবে বরাতের পর সেই ব্যস্ততা ছিল আরও বেশি। তাই বাড়তি চাহিদা বিবেচনায় ব্যবসায়ীরা কাপড়ের মজুত করেছিলেন বেশি। বিক্রিও চলতো সকাল ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত।
কিন্তু রোজা শুরুর দিন থেকে হঠাৎ করেই ইসলামপুরের কাপড়ের দোকানগুলোতে বিক্রি একেবারেই কমে গেছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। করোনার আগে প্রতিবছর যেখানে ১৫ রোজা পর্যন্ত বিক্রয়কর্মীদের কথা বলার সুযোগ থাকতো না, সেখানে তারা এখন অনেকটা অলস সময় পার করছেন।
ব্যবসা জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছি। পাইকারি বাজারে এখন খুচরাও বিক্রি করতে হচ্ছে। সারাদিন দোকানে বসে থেকে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা বিক্রি হয়। এটা কি পাইকারি মার্কেট? কর্মচারী, দোকানভাড়াসহ সব খরচ দিয়ে এখন চলাই মুশকিল হয়ে গেছে। এ অবস্থায় মানসিক সমস্যায় পড়ে গেছি। সামনের দিনগুলোতে বিক্রি হবে কি না তাও বোঝা যাচ্ছে না সোমবার (১১ এপ্রিল) ইসলামপুরের কাপড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিভিন্ন দোকানের কর্মীরা টুলে বসে আছেন। ক্রেতা না থাকায় দোকানের মালামাল ঠিকঠাক করছেন কেউ, কেউ আবার পাশের দোকানের বিক্রয়কর্মীর সঙ্গে গল্পে মেতেছেন। যেখানে ক্রেতাদের একের পর এক মালামাল দেখানো আর দরদাম নিয়ে পুরোদমে ব্যস্ত থাকার কথা, সেখানে অলস সময় পার করা কর্মীরা ক্রেতা দেখলেই করছেন ডাকাডাকি। এমন চিত্র ইসলামপুরের এ এলাকার প্রায় সব মার্কেটেই।
ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, ইসলামপুরে প্রায় শতাধিক মার্কেটে ছোটবড় মিলে পাইকারি কাপড়ের দোকানের সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি। এসব পাইকারি কাপড়ের দোকানের পাশাপাশি ছোট ছোট গার্মেন্টস পণ্যের দোকানও রয়েছে এ এলাকায়। দেশি কাপড়ের পাশাপাশি ভারতীয়, চীনা, পাকিস্তানি বাহারি কাপড় বিক্রি হয় ইসলামপুরে।
করোনার কারণে গত দুই বছর ব্যবসায়ীরা বেচাকেনা করতে পারেননি। অনেকে ব্যবসা ছেড়ে চলে গেছেন। রোজার আগে ১০ থেকে ১২ দিন অনেক বিক্রি হয়েছে। গত দুই বছরের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার একটা একটা আশা জেগেছিল। কিন্তু রোজার শুরুর দিন থেকে হঠাৎ করেই বিক্রি একদম বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা এখন আর ভালো নেই
যেখানে প্রতিদিন গড়ে ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকার কাপড় বিক্রি হতো, সেখানে এখন বিক্রি হয় ১০ থেকে ২০ কোটি টাকার। দোকানগুলোতে কাজ করেন কয়েক হাজার মানুষ। পাজামা-পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ, শাড়ি, থ্রিপিস, প্যান্টপিস, লুঙ্গিসহ বিভিন্ন ধরনের কাপড় উৎপাদন ও বিক্রি হয় ইসলামপুরে। তবে দেশি কিংবা বিদেশি সব কাপড়ের চাহিদা এখন তলানিতে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। রোজা শুরুর আগে দিনে যেখানে দুই থেকে চার লাখ টাকা বিক্রি হতো প্রতিটি দোকানে, সেখানে এখন বিক্রি হয় ২০ হাজার থেকে ৭০ হাজার টাকা।
ঈদুল ফিতরে কাপড়ের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। ফলে সারাদেশ থেকে ইসলামপুরে কাপড় কিনতে আসেন ক্রেতারা। রোজা শুরুর আগ থেকে রমজানের অর্ধেকের বেশি সময়জুড়ে থাকে এই ব্যস্ততা। তবে এবার রোজা শুরুর আগে বিক্রি ভালো হলেও রোজা শুরুর পর তা কমে যায়।
ইসলামপুরের হায়াৎ দোলন মার্কেটের ঢাকা ফেব্রিক্সের ব্যবস্থাপক মো. জসিম উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ব্যবসা জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছি। পাইকারি বাজারে এখন খুচরাও বিক্রি করতে হচ্ছে। সারাদিন দোকানে বসে থেকে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা বিক্রি হয়। এটা কি পাইকারি মার্কেট? কর্মচারী, দোকানভাড়াসহ সব খরচ দিয়ে এখন চলাই মুশকিল হয়ে গেছে। এ অবস্থায় মানসিক সমস্যায় পড়ে গেছি। সামনের দিনগুলোতে বিক্রি হবে কি না তাও বোঝা যাচ্ছে না।
সমবায় মার্কেটের এম এম ফেব্রিক্সের বিক্রয়কর্মী মো. রাসেল বলেন, রোজা শুরুর আগে শবে বরাতের পরে প্রতিদিন এক থেকে দেড় লাখ টাকার শার্ট-প্যান্টের পিস বিক্রি করতাম। রোজা শুরুর দিন থেকে এবার বিক্রি একেবারে কমে গেছে। এখন বিক্রি হয় কয়েক হাজার টাকা। কোনো দিন বিক্রিও হয় না।
চায়না মার্কেটের খাদিজা ফেব্রিক্সের দোকানি মো. শাহাজাদা বলেন, মার্কেটে কাস্টমার নাই। সব খালি। এসময় লোক থাকবে ভরা। কথা বলার সময় নাই। অথচ বসে আছি। দুপুর হয়ে গেছে এখনো কিছুই বিক্রি হয়নি। লায়ন মার্কেটের কে এন ফ্যাশনের ইচার্জ মো. সুহেল জানান, বিক্রি হঠাৎ করে কমে গেলো। বিকেলে তেমন বিক্রি হয় না রোজায়। সকাল থেকে দুপুরেও ক্রেতা খুবই কম।
রয়েল মার্কেটের বাগ-এ নেছার ফেব্রিক্সের বিক্রয়কর্মী মো. আরিফ বলেন, রোজার আগে দিনে কয়েক লাখ টাকা বিক্রি হতো, এখন সেটা কয়েক হাজারে নেমেছে। মানুষের হাতে টাকা না থাকলে কিনবে কী করে।
চায়না মার্কেটের দেওয়ান টেক্সটাইলের বিক্রয়কর্মী মো. হাবিব খানও জানান, দিনে অল্প কয়েকজন আসেন মালামাল কিনতে। তাই তাদের অপেক্ষায়ই বসে আছি। খুচরা বাজারে বিক্রি না হওয়ায় এই বাজারে এমন অবস্থা হয়ে থাকতে পারে বলে জানান তিনি।
ইসলামপুরের বিভিন্ন দোকান ঘুরে দেখা যায়, সেখানে দেশি প্যান্টের পিস ১৩০-১২০০ টাকা, শাড়ি ৫০০-১২০০ টাকা, থ্রিপিস ৫০০-১৪০০ টাকা, গজ কাপড় ৫০-৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ভারতীয় থ্রি পিস প্রতি সেট ১২০০-৩০০০ টাকা, পাকিস্তানি থ্রি পিস প্রতি সেট ৯০০-৬৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি পাঞ্জাবি ৩০০ থেকে ১২০০ টাকা হলেও বিদেশি পাঞ্জাবি ১৫০০ থেকে ৩৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বরিশাল থেকে ইসলামপুরে কাপড় কিনতে এসেছেন মো. আল আমিন। সেখানে কথা হয় তার সঙ্গে। বলেন, আগে আসার সময় পাইনি। আজ আসলাম কিছু থ্রিপিস কিনতে। ১০০ পিস কিনলাম। বিভিন্ন দামের বেশ কয়েকটা দোকান থেকে কিনেছি।
বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে ইসলামপুর বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নেসার উদ্দিন মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, করোনার কারণে গত দুই বছর ব্যবসায়ীরা বেচাকেনা করতে পারেননি। অনেকে ব্যবসা ছেড়ে চলে গেছেন। রোজার আগে ১০ থেকে ১২ দিন অনেক বিক্রি হয়েছে। গত দুই বছরের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার একটা একটা আশা জেগেছিল। কিন্তু রোজার শুরুর দিন থেকে হঠাৎ করেই বিক্রি একদম বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসায়ীরা এখন আর ভালো নেই।
তিনি বলেন, ইসলামপুরের ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়াতে সরকারের সহযোগিতা দরকার। কাপড় বিক্রির ওপর পাঁচ শতাংশ ভ্যাট ব্যবসায়ীদের জন্য বাড়তি চাপ। পাইকারি বেচাবিক্রিতে লাভ সীমিত। ফলে ব্যবসায়ীদের টিকে থাকার স্বার্থে ভ্যাট আরও কমালে ভালো হতো। একই সঙ্গে অনলাইনে ঘরে বসে যারা ব্যবসা করছেন, তাদের ওপর এ ধরনের ভ্যাট বা ট্যাক্স না থাকায় সরকার যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনি অনেক টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন তারা। আর দোকান দিয়ে বসা ব্যবসায়ীরা দিন দিন ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।