বৈরী সম্পর্কের দুটি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ যখন শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানের সম্ভাবনা দেখা যায়, তখন আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে সেটিকে স্বাগত জানানোই রেওয়াজ। গত শুক্রবার (১০ মার্চ) ইরান ও সৌদি আরব যখন সাত বছর পর তাদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে রাজি হলো, তখন বাকি বিশ্ব সেটাই করেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের নেতারা বিবৃতি দিয়ে এই সমঝোতাকে স্বাগত জানিয়েছেন। শুধু ব্যতিক্রম ছিল দুটি দেশের প্রতিক্রিয়া: যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল।
হোয়াইট হাউসের এক মুখপাত্র ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তকে ‘সতর্ক ভাষায়’ স্বাগত জানালেও এটি টিকবে কি না তা নিয়ে সন্দেহপ্রকাশ করেছেন। জন কিরবি বলেছেন, ইরান তাদের অঙ্গীকার রক্ষা করে কি না, তা দেখতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া যা-ই হোক, বেশিরভাগ বিশ্লেষকের ধারণা, চীনের মধ্যস্থতায় ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে এই সমঝোতা ওয়াশিংটনে মারাত্মক অস্বস্তি তৈরি করেছে।
ইসরায়েল অবশ্য প্রকাশ্যে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি। কিন্তু ইসরায়েলি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর এবং মন্তব্য থেকে এটি স্পষ্ট যে, তেহরান-রিয়াদের সমঝোতায় তারা মোটেও খুশি হতে পারেনি।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-সৌদি দ্বন্দ্বের সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হিসেবে দেখা হয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলকে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে দশকের পর দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে তার ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ বজায় রেখেছে, তাতে ইরান-সৌদি দ্বন্দ্ব ব্যাপকভাবে সহায়ক হয়েছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলও এই দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ‘শত্রুর শত্রু আমাদের মিত্র’ নীতি অনুসরণ করে ইরানের বৈরী কিছু উপসাগরীয় দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
স্বাভাবিকভাবেই ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে এবং ভবিষ্যতে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম দুটি মুসলিম দেশ আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলে সেটি উপসাগরীয় অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কে নতুন বিন্যাস তৈরি করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল উভয়েই মনে করে, এই নতুন পরিস্থিতি কোনোভাবেই তাদের স্বার্থের অনুকূলে যাবে না।
ওয়াশিংটনের অস্বস্তি কেন?
ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে সমঝোতার খবর যখন বেইজিং থেকে প্রথম এলো, সেটি ওয়াশিংটনে একই সঙ্গে বিস্ময় ও শঙ্কা তৈরি করে। এর মূল কারণ অবশ্য ইরান-সৌদির সমঝোতা নয়, তাদের অস্বস্তি ও শঙ্কার মূল কারণ এ বিষয়ে চীনের ভূমিকা।
মধ্যপ্রাচ্যে বহু দশক ধরে সব ধরনের সংঘাতে রেফারির ভূমিকায় ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এখন তাদের সেই প্রভাব বলয়ে শান্তিপ্রতিষ্ঠার নামে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে চীন যেভাবে ঢুকে পড়ছে- সেটি মার্কিন নীতিনির্ধারকদের জন্য মারাত্মক মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কয়েক বছর ধরেই চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে মারাত্মক টানাপোড়েন চলছে। সেই প্রেক্ষাপটে চীনের এমন প্রশংসিত ভূমিকাকে বিশ্বজুড়ে মার্কিন একাধিপত্যের প্রতি আরেকটি চ্যালেজ্ঞ বলে বর্ণনা করেছেন কেউ কেউ।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কূটনীতিক ও ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো জেফরি ফেল্টম্যানের কথায়, বেইজিংয়ের এই ভূমিকাকে ‘বাইডেন প্রশাসনের মুখে চপেটাঘাত’ এবং চীন যে এক উদীয়মান শক্তি- সেভাবেই দেখা হবে।
বিশ্ব কূটনীতিতে চীনের উত্থান
বহু বছর ধরে চীনের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল ‘অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক না গলানো’। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের যে ঝোঁক, তাতে এই নীতির ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রেই। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংঘাতে তাদের সক্রিয়ভাবে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাও পালন করতে দেখা যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক বারাক ওবামা প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিক ড্যানিয়েল রাসেল বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে এই সমঝোতায় চীন যে ভূমিকা পালন করেছে, ওয়াশিংটনের জন্য তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য রয়েছে।
তিনি বলেন, যে সংঘাতে চীন কোনো পক্ষ নয়, সেখানে নিজ থেকে উদ্যোগী হয়ে এভাবে কূটনৈতিক সমঝোতার চেষ্টা করা খুবই ব্যতিক্রমী এক ঘটনা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভবিষ্যতে কি আমরা এমনটাই দেখবো? চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন মস্কো সফর করবেন, তখন সেখানে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যে যে মধ্যস্থতার চেষ্টা করবে চীন, এটি কি তার পূর্বাভাস?
চীনের আসল উদ্দেশ্য নিয়ে এরই মধ্যে ওয়াশিংটনে অনেকেই সন্দিহান হয়ে উঠেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান মাইকেল ম্যাককল তো চীনকে ‘শান্তির মধ্যস্থতাকারী’ হিসেবে মানতেই নারাজ। তার মতে, ‘চীন কোনো দায়িত্বশীল শক্তি নয় এবং একজন নিরপেক্ষ ও ন্যায্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দেশটির ওপর আস্থা রাখা যায় না।’
এ ধরনের মধ্যস্থতায় চীনের ক্রমবর্ধমান ভূমিকাকে কোনো কোনো বিশ্লেষক বিশ্ববলয়ে দেশটির ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয়িষ্ণু শক্তির ইঙ্গিত বলে মনে করছেন।
ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের জন অল্টারম্যান বলেন, কোনো লুকোচুরি না করে বেইজিং এখানে যে বার্তা পাঠাতে চাচ্ছে তা হলো, উপসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিশালী সামরিক শক্তির বিপরীতে চীন এক উদীয়মান এবং শক্তিশালী কূটনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে চায়।