ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান ‘যুদ্ধ’ পরিস্থিতি বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ী সংগঠন তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)।
সংগঠনটির নবনির্বাচিত সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ইরান-ইসরায়েল ‘যুদ্ধ’ বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, এ সংঘাতের ফলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যেতে পারে। যা উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেবে এবং এর সরাসরি প্রভাব পড়বে তৈরি পোশাক খাতে।
সোমবার (১৬ জুন) বিকেলে রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ কমপ্লেক্সে সংগঠনের নবনির্বাচিত কমিটির দায়িত্বগ্রহণ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে বিজিএমইএর প্রশাসক আনোয়ার হোসেন নতুন সভাপতির কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন।
মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, আমরা এমন একটি সময়ে দায়িত্ব গ্রহণ করছি, যখন প্রিয় পোশাকশিল্পটি দেশি-বিদেশি নানান চ্যালেঞ্জে জর্জরিত।
তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল, উচ্চ সুদহার, মূল্যস্ফীতি, দুর্বল অবকাঠামো, মজুরি ও জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির চাপে আমরা নিষ্পেষিত। এর মধ্যেই ইসরায়েল-ইরান ‘যুদ্ধ’ পরিস্থিতি নতুন করে উদ্বেগ তৈরি করেছে। যুদ্ধের ফলে যদি তেলের দাম বেড়ে যায়, তবে এর প্রভাব পোশাক খাতেও পড়বে।
এ খাতে সক্ষমতা ধরে রাখতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে মাহমুদ হাসান খান বলেন, আমি বিশ্বাস করি, আপনাদের সহযোগিতায় আমরা এ কাজগুলো করতে সক্ষম হবো।
এদিকে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চালানো পাল্টা হামলায় পশ্চিমা শক্তিগুলো হস্তক্ষেপের বিষয়ে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়ে ইরান জানিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সামরিক ঘাঁটি ও যুদ্ধজাহাজগুলোকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হবে।
শুক্রবার (১৪ জুন) বিকেলে ইরানি রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে এসব তথ্য ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
এ ছাড়া, আরেক ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম রয়টার্স জানায়, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স যদি ইসরায়েলকে প্রতিরক্ষা সহায়তা দেয়, তবে তাদের আঞ্চলিক ঘাঁটি ও সামরিক স্থাপনায় ইরান হামলা চালাতে বাধ্য হবে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, এই হুমকির মাধ্যমে তেহরান স্পষ্ট করে দিয়েছে, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানে বাইরের কোনো রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করলে তা সরাসরি যুদ্ধের পথে ঠেলে দেবে।
ইরানি গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই তিন পশ্চিমা শক্তির আঞ্চলিক নৌঘাঁটি, বিমানঘাঁটি এবং যুদ্ধজাহাজ এখন ইরানের নজরদারিতে রয়েছে।
এর আগে, ইসরায়েল আগেই জানিয়ে এসেছে, ইরানের হামলা মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মিত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে তারা। তবে ইরানের এমন হুমকির পর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্সের নাম করে হুমকি দেওয়া ইরানের কূটনৈতিক কৌশলে এক বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে এর ফলে উত্তেজনা চূড়ান্ত মাত্রায় পৌঁছাতে পারে।
এরই মধ্যে ইরানে ইসরায়েলের হামলার পর গুরুত্বপূর্ণ ‘হরমুজ প্রণালি’ নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। অপরিশোধিত তেলের দামও বেড়ে গেছে।
হরমুজ প্রণালী বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং কৌশলগত একটি সমুদ্রপথ। এটি পারস্য উপসাগরকে ওমান উপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে এবং ইরান ও ওমানের মাঝখানে অবস্থিত।
প্রণালীটির প্রস্থ খুব বেশি নয়- সবচেয়ে সংকীর্ণ জায়গায় মাত্র ৩৯ কিলোমিটার, যার মধ্যে কেবলমাত্র দুটি সংকীর্ণ চ্যানেল দিয়ে বড় জাহাজ চলাচল করতে পারে। ছোট এই পানিপথ দিয়েই প্রতিদিন প্রায় ২০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এবং তেল পণ্য পরিবহন করে। বিশ্বব্যাপী তেল ও গ্যাস সরবরাহের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট।
ইরানে হামলার পর হরমুজ প্রণালি নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তেলের দামও বেড়েছে। যদিও হরমুজ প্রণালি দিয়ে এখনও পরিবহন অব্যাহত রয়েছে।
আন্তর্জাতিক শিপিং সমিতিগুলো ও সামুদ্রিক জাহাজ চলাচল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হরমুজ প্রণালি কার্যত বন্ধ না হলেও জাহাজ মালিকদের গৃহীত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ধীরগতির ঝুঁকি তৈরি করবে। জাহাজ মালিকরা অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করছেন এবং লোহিত সাগর এবং পারস্য উপসাগর থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
এর আগে, গত ১২ জুন দিনগত রাত হঠাৎ ইরানে বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামের এই অভিযানে রাজধানী তেহরানসহ ইরানের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা, পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র ও আবাসিক স্থাপনায় হামলা চালায় ইহুদিবাদী সেনারা।
হামলায় ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি, দেশটির ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান কমান্ডার হোসেইন সালামি, খাতাম আল-আনবিয়া সদরদপ্তরের কমান্ডার ও বিপ্লবী রক্ষীবাহিনীর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মেজর জেনারেল গোলাম আলি রশিদ ও ৬ জন পরমাণু বিজ্ঞানীসহ অন্তত ৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
নেতানিয়াহু বাহিনীর হামলার পর পাল্টা প্রতিশোধ হিসেবে শুক্রবার রাতে ‘অপারেশন ট্রু প্রমিস-৩ নামে’ অভিযান শুরু করে ইরান। অন্তত কয়েক শ’ মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়েছে। এতে ইসরায়েলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এবং অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়। উভয় পক্ষের মধ্যে এখনও সংঘাত চলমান।