গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে যে বিমান হামলা হয়েছে সেটা ইসরায়েল চালিয়েছে বলে দাবি করে ইরান। এর কঠোর জবাব দেওয়া হবে বলে হুমকি দিয়েছিল তারা। ওই বিমান হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ডের সাত সদস্য এবং ছয় সিরীয় নাগরিক নিহত হয়।
লাভ-ক্ষতি
ইসরায়েলের ওপর হামলা সফল হয়েছে বলে দাবি করেছে ইরান। কিন্তু, ইরানের গবেষক এবং লন্ডনভিত্তিক সেন্টার ফর আরব-ইরানিয়ান স্টাডিজের পরিচালক আলী নুরি জাদেহের মতে, এই হামলার মাধ্যমে ইরান কোনো পয়েন্ট স্কোর করেনি। তিনি বলেছেন, বরং এটি ইরানের শাসনব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। কারণ তারা ইসরায়েলের ভূখণ্ডে কোনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে পারেনি। এটি ইরানের কিছু মানুষের মধ্যে উপহাসের জন্ম দিয়েছে।
জাদেহ বিশ্বাস করেন যে, ইরান যদি ইসরায়েলে সাথে তাদের কথিত ‘সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার’ বা ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ অব্যাহত রাখত তবে এর মাধ্যমে তারা আরও অনেক কিছু অর্জন করতে পারত।
জাদেহ বলেছেন, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এখন নিজেদের আরও বেশি শক্তিশালী মনে করছেন।
শনিবারের আগ পর্যন্ত ইসরায়েল ব্যাপক সমালোচনার মুখে থাকলেও ইরানের এই হামলা যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে ইসরায়েলের শক্তিশালী সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছে।
ইসরায়েলি গবেষক বলছেন, হামলা থেকে ইসরায়েলিদের কিছু লাভ হতে পারে, কিন্তু তারা সেটা অন্য উপায়ে হারিয়েছে। তার ধারণা এই হামলার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিকে চিনতে ইসরায়েলের ব্যর্থতা সেইসাথে ইরানকে নিজেদের সীমানায় আঘাত করা থেকে বিরত রাখতে ইসরায়েলের ব্যর্থতার বিষয়টিকে স্পষ্ট করেছে।
অন্য দেশের সাথে ঘনিষ্ঠতায় ফিরেছে
ইসরায়েলি গবেষক এরিক রুন্ডটস্কিও মনে করেন, ইরানের হামলা ইসরায়েলের জন্য লাভজনক হয়েছে। তিনি বলেছেন, এটি রাজনৈতিকভাবে একটি টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করতে পারে। কারণ গত কয়েক মাসের মধ্যে এই প্রথম ইসরায়েল পশ্চিমা সমর্থন উপভোগ করছে। তিনি বলেছেন, সম্পর্কের ক্ষেত্রে এতদিন নজিরবিহীন উত্তেজনার পর ইসরায়েল এই দেশগুলোর সাথে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে ফিরে আসতে পারে।
বিপরীতে, ইরানি গবেষক আলী নুরি জাদেহ বিশ্বাস করেন, তেহরান রাজনৈতিকভাবে সেইসাথে অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক দুইভাবেই হেরেছে। তিনি বলেন, ইরান প্রতিবেশী দেশগুলোর সমর্থন হারিয়েছে এবং তাদের পক্ষে কোনো দেশের সমর্থন ছিল না। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, কিছু মহল থেকে ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সরাসরি যুদ্ধে টেনে আনার চেষ্টা চলছে।
দুই গবেষক উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ চাপ স্বীকার করেন। রুন্ডটস্কি উল্লেখ করেছেন যে, ইসরায়েলের অভ্যন্তরে বড় উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি বলেছেন, যুদ্ধের সাথে সাথে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যার কারণে ক্ষোভ বেড়েছে। সেইসাথে গাজায় আটক জিম্মিদের মুক্ত করার ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় এই ক্ষোভ যেন আরও বেড়েছে।
জাদেহ আরও বিশ্বাস করেন, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনি শুধু পথেঘাটে নয় বরং তার শাসনের মধ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কাছ থেকেও তীব্র চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন। ‘ইরানের আল-কুদস ব্রিগেডের সাত নেতা ইসরায়েলের হামলায় নিহত হওয়ার পর [ইরানি বিপ্লবী] গার্ডের (ইরানি সশস্ত্র বাহিনী) চাপ রয়েছে, কারণ গার্ডরা প্রতিশোধের দাবি করছে।’
‘অগ্নি বার্তা’
লেবাননের অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল হিশাম জাবের- একজন সামরিক ও কৌশলগত বিশেষজ্ঞ এবং বৈরুতে মিডল ইস্ট সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের পরিচালক, তিনি বিবিসি নিউজ অ্যারাবিককে বলেছেন, ‘এই হামলার বিষয়ে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এটি আশ্চর্যজনক ছিল না।’ তিনি বলেছেন, এর কারণ দুই সপ্তাহের ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ পরিস্থিতিকে বিমান হামলার দিকে পরিচালিত করেছে, যখন ইসরাইল ‘আতঙ্কে’ ছিল। ‘এই হামলার কারণে অনেক নাগরিক সেবা ব্যাহত হয়েছে এবং অনেক ইসরায়েলি নাগরিক তাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছেন। ফলে এতে মানসিক এবং বস্তুগত ক্ষতি হয়েছে। জাবের ইরানের এই অভিযানকে ‘অগ্নি বার্তা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কেননা এর মাধ্যমে ইসরায়েলি ভূখণ্ডের আরও ভেতরে পৌঁছানোর ক্ষমতা যেমন প্রকাশ পেয়েছে তেমনি ইসরায়েলি বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থার প্রস্তুতি কেমন সেটা পরীক্ষা করার ক্ষমতাও প্রদর্শন হয়েছে।
তিনি আরও বিশ্বাস করেন, এই হামলা ইরানকে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় রাজনৈতিকভাবে হারানো মর্যাদা পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করেছে। কারণ ইরান এতদিন ‘কৌশলগত ধৈর্যের নীতি’ অনুসরণ করেছিল এবং এর ফলে তারা সামরিক ও কৌশলগতভাবেও লাভবান হয়েছে।
লেবাননের সামরিক বিশেষজ্ঞের ধারণা, ইরান ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষাকে বিভ্রান্ত করার জন্য এই বিপুল পরিমাণ ড্রোন নিক্ষেপ করেছে। তিনি উল্লেখ করেছেন, ইসরায়েলের আয়রন ডোম একা সব ক্ষেপণাস্ত্র আটকাতে পারেনি এবং এজন্য মধ্যপ্রাচ্যের ঘাঁটিতে অবস্থানরত মার্কিন এবং ব্রিটিশ বাহিনীকে সহায়তা করতে হয়েছিল। ‘ইসরায়েল যদি সামরিকভাবে এই হামলার জবাব দেওয়ার পথ বেছে নেয়, তাহলে তারা তাদের ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে ইরানের মূল ভূখণ্ডে পৌঁছাতে পারে, তবে তারা সেটা পারবে না কারণ এখন ইরানের কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখানোর আশঙ্কা রয়েছে,’ জাবের বলেছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘ইসরায়েলি বিমানগুলো ইরানে নির্ভুলভাবে বোমা ফেলতে পারে, তবে তাদের আরব দেশগুলোর ওপর দিয়ে উড়তে হবে- যার ব্যাপারে ইরান সতর্ক করেছে বা এই অঞ্চলে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি থেকে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ করতে হবে, যার অনুমতি যুক্তরাষ্ট্র দেবে না।’
গতিপথ পরিবর্তন এবং আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার
লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ফাওয়াজ গের্জেস যুক্তি দেন যে, ইরানের তুলনায় ইসরায়েল এই হামলা থেকে বেশি লাভ করেছে। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, ইরানের হামলায় ইসরায়েলের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি বা হতাহতের ঘটনা ঘটেনি এবং এখন পুরো পশ্চিমা বিশ্ব ইসরায়েলকে সমর্থন করছে। তিনি বলেন, ইসরায়েলকে অস্ত্র, গোয়েন্দা সহায়তা এবং আর্থিক সহায়তার দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রতি পশ্চিমা সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে।
গের্জেস বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন আদায়ের জন্য জি- সেভেন দেশগুলোর একটি জরুরি শীর্ষ সম্মেলনের আহ্বান জানিয়েছেন। বাইডেন ইসরায়েলকে ভিক্টিম হিসেবে উপস্থাপন করছেন: ‘গাজায় চলমান বিপর্যয়কর এবং জঘন্য ঘটনা থেকে সবার মনোযোগ সাময়িকভাবে সরিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে নেতানিয়াহু রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবেন’ গের্জেস যোগ করেন।
গাজায় ভয়াবহ নৃশংসতার জন্য গত কয়েক মাস ধরে ইসরায়েল পশ্চিমা দেশগুলোর তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি, এখন ইরানের হামলার পর নেতানিয়াহু পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে তাদের সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করে লাভবান হবেন, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে।
‘ইসরায়েলের কৌশলগত ক্ষতি’
কিন্তু গের্জেস ইসরায়েলের ক্ষেত্রে একটি খারাপ দিকও দেখেছেন। তিনি বলেছেন, ইরান হামলা চালানোর ফলে ইসরায়েলের দুর্বলতা ফুটে উঠেছে যা তাদের জন্য এক ধরনের কৌশলগত ক্ষতি। তিনি আরও বলেছেন যে, ইরান তার জনগণ, মিত্র এবং শত্রুদের কাছে ইসরায়েলকে মোকাবিলা করার ইচ্ছা সরাসরি প্রকাশ করে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে।
গের্জেস বিশ্বাস করেন, ইরান এই হামলা চালানোর মাধ্যমে প্রমাণ করেছে যে, ইসরায়েল তার পশ্চিমা মিত্রদের ছাড়া একা নিজেকে রক্ষা করতে পারবে না, কারণ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জর্ডান ইরানের অনেক ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করেছে।
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েল একের পর এক হামলা চালিয়ে প্রমাণ করতে চেয়েছিল যে, ইরান দুর্বল এবং তাদের মুখোমুখি লড়াইয়ের সাহস নেই। সম্প্রতি ইরানের হামলা সেটি দৃষ্টিভঙ্গি গুড়িয়ে দিয়েছে।
গের্জেসের মতে, এই অঞ্চলটি এখন তাণ্ডবের কেন্দ্রে রয়েছে, কেন দুই দেশই তাদের অবস্থান আরও দৃঢ় করার শপথ নিয়েছে। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, এই অঞ্চলটি রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। -বিবিসি বাংলা