প্রায় ২৫ কিলোমিটার এলাকা অরক্ষিত পার্বত্যাঞ্চলের সীমান্তে। এই পথ দিয়ে অবাধে আসছে দেশের সিংহভাগ অস্ত্র, গ্রেনেড, একে-৪৭ রাইফেল, গোলাবারুদ আর আগ্নেয়াস্ত্রের চালান। একই সঙ্গে ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকের চালানও আসছে। রাস্তাঘাট ও ব্রিজ না থাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেখানে নিয়মিত টহল দিতে পারে না বিধায় অনেকটা বিনা বাধায় ঢুকে পড়ছে অস্ত্র ও মাদক।
সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনীর বিশাল আস্তানা খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলার সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় গহিন অরণ্যে রয়েছে। চারদিকে খাল। পার্বত্যাঞ্চলের সশস্ত্র চারটি গ্রুপের মধ্যে ইউপিডিএফ (প্রসিত) এই এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মূল আস্তানা সেখানেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে অভিযান চালায়, তখন সন্ত্রাসীরা সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
ব্যবসায়ী, পর্যটকসহ স্থানীয় লোকজনকে অপহরণ করে ঐ আস্তানায় রেখে মুক্তিপণ আদায় করে। অনেককে সেখানে হত্যাও করে। বাইরে থেকে চোরাই পথে আসা অস্ত্র সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় এই দুর্গম এলাকায় সন্ত্রাস দমন কার্যক্রম অনেকটা হুমকিতে পড়েছে। রাস্তাঘাট ও ব্রিজ করতে গেলে বাধা দেয় সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা। তাদের বাধার মুখে অনেক সময় উন্নয়নমূলক নির্মাণকাজ করা সম্ভব হয় না। পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সশস্ত্র সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফের (প্রসীত) সশস্ত্র সদস্যরা খাগড়াছড়ির রামগড়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রায় ৮ কোটি টাকার ব্রিজ ও রাস্তা নির্মাণের দুটি প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দিয়েছে।
এর মধ্যে রামগড় সদর ইউনিয়নের বৈদ্যপাড়ায় পিলাক নদীর ওপর প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকার ৭৮ মিটার দীর্ঘ আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করার পর ঐ সংগঠনের সশস্ত্র সদস্যরা বাধা দিলে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হন। নির্মাণকারী ঠিকাদার বারবার তাদের চাঁদা দিয়েও কাজ চালিয়ে যেতে পারছেন না।
এর আগেও ঐ এলাকায় এলজিইডির কয়েক কোটি টাকার তিনটি খালের ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্পের কাজও করা যায়নি সংগঠনটির বাধায়। যদি রাস্তাঘাট ও ব্রিজ হয়, তাহলে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়মিত টহল থাকবে। নিরাপদে অভিযান পরিচালনা করা সহজ হবে। এতে তাদের সেখানে নিরাপদ আস্তানা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। অপরদিকে পাহাড়ি-বাঙালিরা নিরাপদে থাকবে। এ কারণে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা হতে দিতে চায় না তারা। করোনার মধ্যেও চাঁদা দিয়ে জীবন রক্ষা করতে হচ্ছে পাহাড়ি-বাঙালিদের। এ ব্যাপারে ইউপিডিএফের (প্রসিত) কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ও মুখপাত্র নিরন চাকমার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
রামগড় উপজেলা সদর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে বৈদ্যপাড়ার প্রকল্প এলাকার হাজাছড়া গ্রামের বাসিন্দা ও ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি নিউরি মারমা বলেন, ‘দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ব্রিজের নির্মাণকাজ শুরু হলে ভেতরের পার্টি (ইউপিডিএফ) কাজ বন্ধ করে দিয়েছে বলে শুনেছি।’ রামগড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের নেতা শাহ আলম মজুমদার জানান, বিষয়টি উপজেলা সমন্বয় সভা ও রামগড়ে জেলা প্রশাসকের মতবিনিময় সভায়ও তিনি উত্থাপন করেছেন।
রামগড় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মো. সাহাব উদ্দিন বলেন, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রামগড়-মটিরাঙ্গা সীমান্তে অভ্যা এলাকায় এলজিইডির একটি ব্রিজ নির্মাণ প্রকল্পের কাজ ইউপিডিএফের বাধার কারণে আর করতে পারেননি। ২ কোটি ১৩ লাখ টাকার ঐ ব্রিজের কাজ শুরুর আগে ইউপিডিএফ ও জেএসএস নামে দুই গ্রুপকে অগ্রিম ৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা চাঁদাও দেওয়া হয়। কাজ শুরুর কয়েক দিন পর হঠাত্ এসে তারা কাজ বন্ধ করে দেয়। এমনকি সাইড থেকে কোনো নির্মাণসামগ্রী ফেরত আনতে দেয়নি তারা।
সে সময় এলজিইডির ঐ একই প্রকল্পে পার্শ্ববর্তী লক্ষ্মীছড়া ও ধলিয়া খালে অপর দুটি ব্রিজের নির্মাণকাজও করতে দেওয়া হয়নি। ফলে এ তিনটি ব্রিজ নির্মাণের প্রকল্প বাতিল হয়ে যায়। ভারতীয় সীমান্তের অদূরে রামগড় ও মাটিরাঙ্গা লাগোয়া হাজাছড়া, ডাক্তারপাড়া, কলাপ্রুপাড়া, অভ্যা, জরিটিলা, তৈকান্ত, রসিয়াপাড়া প্রভৃতি এলাকাকে পিলাক, অভ্যা, ধলিয়া ও লক্ষ্মীছড়া নদী-খাল উপজেলা সদরের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে।
বৈদ্যপাড়া ব্রিজ ও খাগড়াবিল-বাটনাতলী রাস্তা নির্মাণের কাজ বন্ধ করে দেওয়ার কথা স্বীকার করে এলজিইডির রামগড় উপজেলা প্রকৌশলী তন্ময় নাথ বলেন, ঠিকাদার কাজ করতে না পারলে প্রকল্প বাতিল হয়ে যাবে। রামগড় উপজেলা চেয়ারম্যান বিশ্ব প্রদীপ কার্বারি বলেন, বিষয়টি রামগড় বিজিবির অধিনায়ককে অবহিত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার চাইলে বিজিবি নিরাপত্তা দেবে বলেও অধিনায়ক তাকে আশ্বাস দিয়েছেন। এদিকে, রামগড়ে প্রায় ৮ কোটি টাকার আলোচ্য সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানান উপজেলা নির্বাহী অফিসার মু. মাহমুদ উল্লাহ মারুফ। তবে এখন তিনি খোঁজ নেবেন বলে জানান।