বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন যে, ইউক্রেনে রাশিয়া হামলা চালালে পূর্ব ইউরোপে অনিশ্চয়তার নতুন যুগের সূচনা করতে পারে। সরবরাহ শৃঙ্খল ও বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবের পরিবর্তনে বাধ্য করতে পারে যাতে পশ্চিমাদের প্রতি বাকি বিশ্বের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই ভয় এখনো এড়ানো যেতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে তারা এটাও বলছেন যে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলছেন, ইউক্রেনে স্বল্পমেয়াদি একটা হামলা হতে পারে। বেলারুশের সাবেক ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত এবং বর্তমানে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ থিংক ট্যাংকের রাশিয়া ও ইউরেশিয়া বিষয়ক সিনিয়র ফেলো নাইজেল গোল্ড-ডেভিসের মতে, যে কোনো যুদ্ধই ভয়ংকর হবে। বিশ্লেষকরা একমত যে কোনো আক্রমণের প্রভাব কতটা দীর্ঘ এবং সুদূরপ্রসারী হবে তা নির্ধারণে ন্যাটোর প্রতিক্রিয়ার কার্যকারিতাও গুরুত্বপূর্ণ। তবে রাশিয়ার যে কোনো পদক্ষেপ পশ্চিমা দেশগুলোকে ভয়াবহ পরীক্ষায় ফেলে দেবে এবং অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার অনিশ্চয়তার একটি সিরিজ তৈরি করবে।
১৯৮০-এর দশকের পর ইউরোপ এখন সবচেয়ে গুরুতর নিরাপত্তা সংকটে বলে মনে করে গোল্ড-ডেভিস। লন্ডনভিত্তিক থিংক ট্যাংক চ্যাথাম হাউসজর রাশিয়া-ইউরেশিয়া প্রোগ্রামের পরিচালক জেমস নিক্সি বলছেন, রাশিয়া এবং পশ্চিমা বিশ্ব সবসময়ই বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মতবিরোধে ছিল এবং সেই মৌলিক মতপার্থক্যটি বছরের পর বছর ধরে কার্পেটের নিচেই রয়ে গেছে। এখন রাশিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এটি তার বিপক্ষে যাচ্ছে। নিক্সি বলছেন, এটি বাস্তব-বিশ্বের সমস্যা যার বৈশ্বিক প্রভাব রয়েছে।
ইউক্রেনের বাইরে সবচেয়ে তাত্ক্ষণিক প্রভাব পড়বে পূর্ব ইউরোপীয় এবং বাল্টিক দেশগুলোতে। ঘরের দরজায় তারা যুদ্ধবাজ রাশিয়াকে দেখতে পাবে। গোল্ড-ডেভিস বলেন, ইউক্রেন বেশ কয়েকটি ন্যাটো রাজ্যের সীমানা ঘেঁষে গড়ে উঠেছে। তাদের নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হবে। নিক্সি বলছেন, যদি রাশিয়াকে আবারও সীমানা পুনর্র্নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়, বা নিরুত্সাহিত করা না হয়, তাহলে স্পষ্টতই রাশিয়া সেখান থেকে শিক্ষা নেবে এবং তার পরবর্তী গন্তব্য কোথায় তা নির্ধারণে ব্যস্ত থাকবে। তখন অনেক কিছু ন্যাটোর প্রতিক্রিয়ার ওপর নির্ভর করবে এবং যে দেশগুলো নিজেদের ফায়ারিং লাইনে দেখতে পাবে সেখানে সৈন্য মোতায়েন করা হবে।
পেন্টাগনের মুখপাত্র জন কিরবি বলেছেন, পূর্ব ইউরোপে সম্ভাব্য মোতায়েনের জন্য সাড়ে ৮ হাজার মার্কিন সৈন্যকে উচ্চ সতর্কতায় রাখা হয়েছে। তিন মার্কিন কর্মকর্তাও সিএনএনকে বলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্ররা আগামী দিনে রোমানিয়া, বুলগেরিয়া এবং হাঙ্গেরিতে অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েনের জন্য পাঠাতে পারে। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয় এবং জোট সম্ভবত সেখানে সৈন্য পাঠাবে না। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার অনুপ্রবেশের পর সম্ভবত ইউরোপের পূর্ব প্রান্ত বরাবর বড় আকারের সৈন্য মোতায়েন থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত রাশিয়া ইউক্রেনের জমি দখল করে রাখবে। এই পরিস্থিতি সেই শীতল যুদ্ধের স্মৃতিকেই ফিরিয়ে আনবে।
আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা গবেষণা সংস্হা রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউটের পরিচালক নিল মেলভিন বলেছেন, ন্যাটোর সামনের সারিতে এমন প্রতিক্রিয়া থাকতে হবে যা একটি প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে এবং এটিকে ঘিরে সম্পূর্ণ যুদ্ধ কৌশল থাকতে হবে। মেলভিন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে জাতিগুলোর দীর্ঘ সময়ের জন্য যুদ্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে নতুন বাহিনী আনতে এবং সাইবার যুদ্ধের সঙ্গে লড়াই করতে যথেষ্ট বড় শক্তির প্রয়োজন হবে। ফলে সম্ভাব্য এই যুদ্ধ ইউরোপে বিশাল পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
একটি আক্রমণের অর্থনৈতিক পরিণতি কী হবে তা কেউ জানে না। তবে বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য প্রভাব তো থাকেই। ইউক্রেনের কৃষি উত্পাদনে ব্যাঘাত ঘটিয়ে খাদ্য সরবরাহের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। দেশটি বিশ্বের চারটি প্রধান শস্য রপ্তানিকারকদের মধ্যে একটি। আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বে ভুট্টা আমদানিতে ইউক্রেন ষষ্ঠ স্থানে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। তাই এর উত্পাদনে সরাসরি আঘাত কিছু খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহকে প্রভাবিত করতে পারে। তবে আরও বেশি বিষয় হলো জ্বালানি সরবরাহের ওপর ব্যাপক সম্ভাব্য প্রভাব এবং রাশিয়ার ওপর কঠোর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পরিণতি। পরমাণু অস্ত্রের কথা বাদ দিলে রাশিয়ার হাতে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র কিন্তু তার সেনাবাহিনী বা বিমান বাহিনী নয়, সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র তার জ্বালানি।
ইউরোপের মোট তেল এবং গ্যাস সরবরাহের ২৫ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। লাটভিয়া, স্লোভাকিয়া, ফিনল্যান্ড এবং এস্তোনিয়ার মতো দেশগুলো রাশিয়ার জ্বালানির ওপর ১০০ ভাগ নির্ভরশীল। জার্মানির প্রায় অর্ধেক গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে। ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে ইউক্রেন হচ্ছে রাশিয়ার প্রবেশ দ্বার। রাশিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ গ্যাসের সরবরাহ যায় ইউক্রেনের ভেতরের পাইপলাইন দিয়ে। কাজেই ইউক্রেন রাশিয়ার প্রভাব বলয়ের বাইরে চলে গেলে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়া তার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হতে পারে বলে আশঙ্কা করে। তবে ইউক্রেনকে পাশ কাটিয়ে রাশিয়া বাল্টিক সাগরের নিচ দিয়ে জার্মানি পর্যন্ত নর্ড স্ট্রিম-২ নামে নতুন একটি গ্যাস পাইপলাইন বসিয়েছে। কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেনে অভিযান চালালে এই পাইপলাইন প্রকল্প আর সামনে আগাবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইউরোপ যেভাবে রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, তাতে রাশিয়া অন্য দেশগুলোর ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের সুযোগ পেয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই গ্যাসের এই নির্ভরতাকে কাজে লাগানোর অভিযোগ উঠেছে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি গত বুধবার জানায়, রাশিয়া তার রপ্তানি হ্রাস করে ইউরোপে গ্যাসের কম সরবরাহে অবদান রেখেছে।
গোল্ড-ডেভিস জানান, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রাশিয়াকে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সরবরাহ এবং উচ্চ মূল্যের সমস্যাগুলোকে বাড়িয়ে তুলতে দেখা গেছে। জ্বালানি খরচের মূল্যস্ফীতি ইতিমধ্যেই ইউরোপের লাখ লাখ বাড়িতে আঘাত করেছে। ব্রিটেনে ভোক্তাদের এ বছর তাদের ঘর গরম করতে এবং আলো জ্বালাতে প্রায় ১ হাজার ৭৫ ডলার বেশি ব্যয় করতে হবে। ব্যাংক অব আমেরিকার মতে, পূর্ব ইউরোপে সংঘর্ষ বিভিন্ন দেশে জীবনযাত্রার সংকট আরো গভীর করে তুলবে।
ইউরোপের উদ্বেগের বিষয় হলো যে চীনকে ধীরে ধীরে গ্যাস এবং কয়লা সরবরাহের মাধ্যমে রাশিয়া ইউরোপের বাজারের সঙ্গে বিচ্ছেদের পরিকল্পনা করতে পারে। এই পরিবর্তন ইউরোপের অর্থনীতির জন্য বিশাল ধাক্কার কারণ হবে। মেলভিন বলছেন, তাদের অন্য কিছু করতে হবে। ইউরোপের অনেক দেশ পরমাণু বিদ্যুতকেন্দ্র থেকে সরে আসতে চায়। কিন্তু সেই পরিকল্পনা থেকে তারা সরে যেতে পারে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার প্রস্তুতি চলছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার প্রধান ব্যাংক, তেল ও গ্যাস খাত এবং প্রযুক্তি আমদানিতে আঘাত করতে পারে। তবে ইউরোপ এবং বাকি বিশ্বেও এর প্রভাব অনুভূত হবে। বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র এবং মানবতা বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত আন্ডার সেক্রেটারি নাথান সেলসের মতে, যে কোনো সময় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া যায়। তবে এর প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের এবং তার মিত্রদেরও ঝুঁকিতে ফেলবে। গোল্ড-ডেভিসের মতে, রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালাতে সক্ষম হলে পশ্চিমা বিশ্বের শক্তি পরীক্ষা হয়ে যাবে। এ থেকে সবচেয়ে বেশি শিক্ষা নেবে চীন। তারা তাইওয়ান নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলতে পারে।