পতিত হাসিনা সরকারের আমলের বহুল আলোচিত আয়নাঘর নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করেছে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি। আয়নাঘরে বন্দি থাকা ছয় জনের সাক্ষাৎকারের উঠে এসেছে, ওইসব কক্ষগুলো ছিলো মূলত শত শত গোপন বন্দিশালা।
এসব বন্দিশালায় বৈদ্যুতিক শক, নির্যাতন, রাতভর জেরা চালানো হতো। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সময় এই গোপন বন্দীশালাগুলোর মাধ্যমে রাজনীতি, মতাদর্শ ও স্বাধীন মত প্রকাশের বিরুদ্ধে নিপীড়ন চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
আট বছর ধরে নিখোঁজ থাকা আইনজীবী মীর আহমাদ বিন কাসেম যখন স্মৃতি আঁকড়ে ধরে একটি রহস্যময় জায়গার সন্ধান দেন, তখন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের একদম কাছেই মিলল একটি গোপন কারাগার। দেয়াল ভেঙে সামনে আসে ইট ও কংক্রিটে তৈরি একটি জানালাবিহীন ভবন। সেখানেই ছোট ছোট অন্ধকার কক্ষ, যেগুলো ছিল নির্যাতন ও নিঃসঙ্গ কারাবাসের ঘর।
বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিবিসি বলেছে, এই কারাগারের অবস্থান ছিলো এমন জায়গায় যেটি রাজধানীর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মাত্র কিছু দূরে। যেখানে প্লেনের অবতরণের শব্দ কাসেমের স্মৃতিতে গেঁথে ছিল। সেই শব্দই ছিল তার পথনির্দেশক। সেই ভবন এখনও আছে, তবে অনেক প্রমাণ মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে।
মীর কাসেমের ভাষ্যমতে, এটা যেন জীবন্ত কবর। বাইরের দুনিয়ার সাথে কোনো সংযোগই ছিল না। তিনি গোটা সময়টা ছিলেন র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র্যাব পরিচালিত এই গোপন কারাগারে। আগে ধারণা করা হতো তিনি ঢাকার গোয়েন্দা সংস্থার ‘আয়নাঘর’ নামক কোন স্থানে ছিলেন।
তদন্তকারীরা বলছেন, দেশে এমন গোপন কারাগারের সংখ্যা ৫০০ থেকে ৭০০-এরও বেশি হতে পারে, যা ছিল একটি পরিকল্পিত ও কাঠামোগত নিপীড়ন ব্যবস্থা।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বিবিসিকে বলেন, এই সব গুমের ঘটনাগুলো সরাসরি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনে হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সময় এই গোপন বন্দিশালাগুলোর মাধ্যমে রাজনীতি, মতাদর্শ ও স্বাধীন মত প্রকাশের বিরুদ্ধে নিপীড়ন চালানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিএনপি ঘনিষ্ঠ ছাত্রনেতা আতিকুর রহমান রাসেলও বন্দি ছিলেন এখানেই। বলেন, গাড়িতে উঠেই চোখ বেঁধে ফেলল, হাতকড়া পরিয়ে এক জায়গায় নিয়ে গেল। তারপর শুরু হলো প্রশ্ন আর মারধর।
২৩ বছর বয়সী আরেকজন ভুক্তভোগী রহমাতুল্লাহ জানান, ওই জায়গায় শোবার মতো জায়গাও ছিলো না। ড্রেনের ওপর ঘুমাতাম, পা ছড়িয়ে শোয়া যেতো না। ওটা কোনো মানুষের থাকার জায়গা না। অনেকে বলছেন, তাদের ওপর বৈদ্যুতিক শক, নির্যাতন, রাতভর জেরা চালানো হতো।
এসব গোপন কক্ষে নির্যাতন করার অভিযোগে এখন পর্যন্ত ১২২ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। তবে কাউকে এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি। আইনজীবী কাসেম বলেন, যারা ফ্যাসিবাদী সরকারের সহায়তা করেছে, তারা আজও দায়িত্বে আছে। বিচার না হলে এই অত্যাচার থামবে না।
বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্রের পথে এগোনোর এই সুযোগে অতীতের নির্যাতনের বিচার করাই ভবিষ্যতের নিরাপত্তার চাবিকাঠি হতে পারে। আর তাই ভুক্তভোগীরা চান সঠিক বিচার।