নানা কারণে প্রতিনিয়ত মানুষের নগদ টাকা ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। এতে ক্রমেই ব্যাংকে কমে আসছে টাকা। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ব্যাংকে টাকা ফেরাতে উদ্যোগ নিচ্ছে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক। টাকা ফেরাতে ইতোমধ্যেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে উদ্যোগ নেওয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর।
প্রশ্ন হলো কী কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো? অনলাইন ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডের এই সময়ে তো মানুষের হাতে খুব বেশি নগদ টাকা থাকা দরকার নেই। এখন তো মানুষের ব্যাংকে আগের চেয়ে বেশি টাকা রাখার কথা। কিন্তু ঘটছে উল্টোটা। তাহলে ক্যাশলেস সোসাইটি গড়ার যে চিন্তা তা বাস্তবায়ন হবে কীভাবে?
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ‘ব্যাংকে মানুষ টাকা রাখা কমিয়ে দেওয়ার মূল কারণ আস্থাহীনতা। এই আস্থাহীনতার নানা কারণ আছে। তবে সব কারণ মিলেই আস্থাহীনতার সংকট তৈরি হয়। এর ফলে ব্যাংকে তারল্য সংকট তৈরি হয়। যার ফলাফল বাংকগুলোও গ্রাহকদের ঋণ দিতে পারে না। ব্যাংকের ব্যবসাই হলো আমানত গ্রহণ এবং ঋণ দেওয়া। এখানে স্থবিরতা তৈরি হলে তা সংকটেরই ইঙ্গিত দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে এটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। তাতে আসলে সংকট শেষ পর্যন্ত বেড়ে যায়, মূল্যস্ফীতি ঘটে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বুধবার বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) নিয়ে বৈঠক করেছেন। সেখানে তিনি ব্যাংকে টাকা ফিরিয়ে আনতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
সাধারণভাবে দেশে মোট অর্থের ১০-১২ শতাংশ মানুষের হাতে নগদ থাকার কথা। এই অর্থ দিয়ে তারা দৈনন্দিন চাহিদা ও বিভিন্ন কেনাকাটা করেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে এখন মানুষের হাতে নগদ অর্থ ১৬ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত জুন শেষে মানুষের হাতে টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ১০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। সাধারণভাবে দুই লাখ ৫৫ হাজার থেকে দুই লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা মানুষের হাতে নগদ থাকে। এর আগে কয়েকটি ব্যাংকের জালিয়াতির তথ্য সামনে আসার পরও গত ডিসেম্বরে মানুষের হাতে ছিল সর্বোচ্চ দুই লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা।
আর ব্যাংকিং খাতে এখন অতিরিক্ত তারল্য আছে তিন হাজার ৯০৯ কোটি টাকা। এক বছর আগে অতিরিক্ত তারল্য ছিল দুই লাখ তিন হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সিআরআর ও এসএলআর রাখার পর যে অর্থ উদ্বৃত্ত থাকে তাই অতিরিক্ত তারল্য।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, কমবেশি চার হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্যকে বেশ কম এবং ঝুঁকিপূর্ণই বলতে হবে। কিছু ব্যাংকের অবস্থা বেশ খারাপ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নিয়মিতভাবে চার শতাংশ নগদ অর্থ জমা দিতে না পেরে জরিমানা দিচ্ছে।
যমুনা ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে ভাবলে মানুষের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ব্যাংকে টাকা রাখা কেউ কেউ অর্থনৈতিকভাবে লাভের মনে করছেন না। ব্যাংকের সাথে কাস্টমারের সম্পর্ক হলো আস্থার। সে তার ইচ্ছেমতো টাকা জমা দিতে পারবে, ইচ্ছেমতো তুলতে পারবে। কাউন্টারে যদি জিজ্ঞেস করা হয় আপনি টাকা তুলছেন কেন তাহলেই সমস্যা।’
নুরুল আমিন বলেন, ‘ব্যাংক খাত যত কম নেগেটিভ নিজউ তৈরি করবে তত তার ওপর মানুষের আস্থা থাকবে। এখন ঋণ খেলাপি, অর্থপাচারসহ নানা ধরনের খবর ব্যাংকের ওপর আস্থাহীনতা তৈরি করে।’
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যেভাবে টাকা ব্যাংকে ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছেন, সেইভাবে টাকা ব্যাংকে ফিরবে না বলে মনে করেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘যেসব কারণে ব্যাংকগুলোতো তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে তার দূর করার ব্যবস্থা নিতে হবে। তা তো আমরা নিতে দেখছি না।’
এই অর্থনীতিবিদের মতে, যেসব কারণে মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখতে অনাগ্রহী হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে- আমানতের সুদের হার কম ও ব্যাংকের নানা ধরনের চার্জ। এই দুইটি কারণে মানুষ মনে করে ব্যাংকে টাকা রাখলে কমে যায়। ব্যাংকে টাকা না রাখার আরেকটি কারণ, মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের নগদ টাকা আগের চেয়ে বেশি লাগছে। ফলে ব্যাংকে আগের চেয়ে মানুষ কম টাকা রাখছে। এছাড়াও আস্থার সংকটও অন্যতম একটি কারণ। ব্যাংকিং খাতে নানা অঘটনের জন্য আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে। দেড় লাখ কোটি টাকার ইসলামী ব্যাংক তো তার উদাহরণ। পাশাপাশি রিজার্ভ কম থাকার কারণেও তারল্য বাড়ছে না।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘এর বাইরে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক কারণে এখনো ব্যাংকে টাকা না রাখার পরিস্থিতি হয়নি। তবে আরও পরে হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের ব্যবসাই হলো আমানত গ্রহণ ও ঋণ দেওয়া। আমানত কমে যাওয়ায় ঋণ দেওয়ার সক্ষমতা ব্যাংকগুলোর কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ টাকা ছাপাচ্ছে। টাকা ছাপিয়ে সাময়িক উপশম হলেও পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। মূল্যস্ফীতি বাড়ে। অর্থনৈতিক সক্ষমতার বাইরে টাকা ছাপলে তা অর্থনীতির ক্ষতি করে।’
সূত্র: ডয়েচে ভেলে