প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রী ও পথচারী অজ্ঞানপার্টি ও ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। এছাড়া জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন অনেকেই। এসব ভুক্তভোগীর বেশিরভাগই কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা নেন না। এ কারণে সংঘবদ্ধ অজ্ঞানপার্টি ও ছিনতাইকারী চক্রের তৎপরতা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে।
অজ্ঞানপার্টি ও ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা সবাই মাদকাসক্ত। রমজান মাস থেকে এ পর্যন্ত ১৩২ জন ছিনতাইকারীসহ মলম পার্টির সদস্যদের গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-৩।
মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর পল্টন, মতিঝিল, শাহবাগ, হাতিরঝিল ও খিলগাঁও এলাকায় সাঁড়াশি অভিযানে সংঘবদ্ধ মলমপার্টি ও ছিনতাইকারী চক্রের মূলহোতাসহ মোট ৪৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-৩।
বুধবার সকালে রাজধানীর টিকাটুলী র্যাব-৩ এর সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান এই ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (সিও) আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।
এ সময় র্যাব-৩ এর উপ-অধিনায়ক মেজর রাহাত হারুন খান, মগবাজার ক্যাম্পের কমান্ডার মেজর জুলকার নায়েন প্রিন্স ও স্টাফ অফিসার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বীণা রানী দাস উপস্থিত ছিলেন।
একটি গোয়েন্দা তথ্যের সূত্রের বরাত দিয়ে র্যাব অধিনায়ক বলেন, রাজধানীতে মাসে প্রায় ৩৫টি ছিনতাইসহ মলমপার্টি ও অজ্ঞানপার্টির ঘটনা ঘটে। রাজধানীতে ২০০ স্পটে ৫০টি চক্রের ২০০ সদস্য ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়িত। চক্রের সদস্যরা ছিনতাইয়ের সময় বাধা পেলে মরণাঘাত করতেও পিছপা হয় না। চলতি বছরের গত পাঁচ মাসে ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে আহত হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। এসব ঘটনায় ৪১টি মামলা হয়েছে।
চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন নামে পরিচিত। সালাম পার্টি, মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টি ও হেন্ডসেফ পার্টি। তাদের ছিনতায় ও অপরাধের ধরণও আলাদা। তারা বিভিন্ন বিভিন্ন কৌশালে কাজ করে। তবে এই চক্রের সদস্যরা অধিকাংশই গার্মেন্টসকর্মী, সিএনজি চালক ও ইট ভাটার শ্রমিক। তারা সারাদিন কাজ করে রাতে সংগঠিত হয়ে এসব অপরাধ করছে।
আসন্ন ঈদুল আযহাকে সামনে রেখে সংগঠিত হতে শুরু করেছিল এই সব অপরাধী চক্র। এছাড়া তারা বিভিন্ন গুরুর হাটকে টার্গেট করেই ছিনতাইসহ অন্যান্য অপরাধের পরিকল্পনা করছিল বলে জানান র্যাবের এই কর্মকর্তা।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন- মিজু, উজ্জল, স্বাধীন, জিসান, মাসুদ, রানা মিয়া, সোহেল মিয়া, মাহফুজ শেখ, আলামিন, পংকজ কুমার ভৌমিক, বিল্লাল, আব্দুল হালিম, জিসান শান্ত, রাজিব মৃধা, শামীম, মেরাজ, সুমন, রিপন মোল্যা, ফরহাদ, রিংকু, সজিব হোসেন, আরিফ হোসেন, বেলাল হোসেন, রবিন, সাগর, ইয়াছিন, শাকিল আহমেদ সুমন, জুয়েল রানা, সাদ্দাম শেখ, শাকিব মিয়া, শান্ত, আরিফ হোসেন, পারভেজ, জালাল, সোহাগ, রাব্বি, শামীম, আবু বক্কর সিদ্দিক, রাকিব, রানা, অলীমউদ্দিন শেখ, তারেক হোসেন, নুর ইসলাম ও আজিজ।
র্যাব জানায়, এসব আসামির কাছ থেকে পাঁচটি সুইচ গিয়ার, তিনটি চাকু, চারটি ক্ষুর, তিনটি এন্টিকাটার, একটি তার, দুটি ব্লেড, চারটি গামছা, ১৯টি বিষাক্ত মলম, ১৫টি মোবাইল ফোন, ১৪টি সিমকার্ড, ৭৬০ গ্রাম গাঁজা ও নগদ ১৪ হাজার ৬০৫ টাকা উদ্ধার করা হয়।
ছিনতাইকারীদের টার্গেট:
আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, রাজধানীর লঞ্চঘাট, বাসস্ট্যান্ড, রেল স্টেশন এলাকায় অজ্ঞানপার্টির সদস্যরা ঘোরাফেরা করে। তারপর সহজ সরল যাত্রীদের টার্গেট করে কখনও তাদেরকে ডাব, কোমল পানীয় কিংবা পানির সাথে বিষাক্ত চেতনানাশক ঔষধ মিশিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করে। আবার কখনও যাত্রীবেশে লঞ্চ, বাস ও ট্রেনে চড়ে যাত্রীদের পাশে বসে তাদের নাকের কাছে চেতনানাশক ঔষধে ভেজানো রুমাল দিয়ে যাত্রীদের অজ্ঞান করে থাকে।
সিও বলেন, বিষাক্ত পানীয় সেবন করার, বিষাক্ত স্প্রের ঘ্রাণ নেওয়ার পর যাত্রী অজ্ঞান হয়ে পড়লে তার সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তারা ভিড়ের মধ্যে মিশে যায়। এছাড়াও কখনও ভিড়ের মধ্যে যাত্রীদের চোখে-মূখে বিষাক্ত মলম বা মরিচের গুড়া বা বিষাক্ত স্প্রে করে যাত্রীদের যন্ত্রণায় কাতর করে সর্বস্ব কেড়ে নেয়। এরপর কোন সহৃদয় ব্যক্তি অজ্ঞান ও অসুস্থ যাত্রীকে হাসপাতালে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে। চেতনানাশকের পরিমাণ বেশী হলে ওই ভুক্তভোগীর জ্ঞান ফিরতে ৭২ ঘন্টা পর্যন্ত লেগে থাকে। অজ্ঞানপার্টির শিকার ব্যক্তি শারিরীকভাবে দুর্বল ও বয়স্ক হলে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
অন্যদিকে ভুক্তভোগীর চোখে-মূখে বিষাক্ত মলম লাগানোর ফলে তার দৃষ্টিশক্তি চিরতরে হারানোর সম্ভাবনা থাকে। অজ্ঞানপার্টির শিকার ভূক্তভোগীর চেতনা না থাকায় তিনি পরিবারের সাথে জ্ঞান ফেরার পূর্ব পর্যন্ত যোগাযোগ করতে পারেন না।
ছিনতাইপ্রবণ এলাকা:
খিলগাঁও মালিবাগ রেইল গেইট, দৈনিক বাংলা মোড়, পীরজঙ্গি মাজার ক্রসিং, কমলাপুর বটতলা, মতিঝিল কালবার্ট রোড, নাসিরের টেক হাতিরঝিল, শাহবাগ, গুলবাগ, রাজউক ক্রসিং, ইউবিএল ক্রসিং পল্টন মোড়, গোলাপ শাহর মাজার ক্রসিং, হাইকোর্ট ক্রসিং, আব্দুল গণি রোড, মানিকনগর স্টেডিয়ামের সামনে, নন্দীপাড়া ব্রিজ, বাসাবো ক্রসিং এলাকায় সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বেশি দেখা গেছে।
অন্যদিকে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীরা রাজধানীর বিভিন্ন অলি গলিতে ওঁৎপেতে থাকে। সুযোগ পাওয়া মাত্রই তারা পথচারী, রিকশা আরোহী, যানজটে থাকা সিএনজি অটোরিকশার যাত্রীদের ধারালো অস্ত্র দেখিয়ে সর্বস্ব লুটে নেয়। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত তুলনামূলক জনশূন্য রাস্তা, লঞ্চঘাট, বাসস্ট্যান্ড, রেল স্টেশন এলাকায় ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তাদের ছিনতাইকাজে বাধা দিলে তারা নিরীহ পথচারীদের প্রাণঘাতী আঘাত করতে দ্বিধাবোধ করে না।
এসব অজ্ঞানপার্টি ও ছিনতাইকারীকে আইনের আওতায় আনার ফলে পথচারীদের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। রাজধানীবাসী এবং দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে রাজধানীতে আগত যাত্রীরা যাতে নিরাপদে দৈনন্দিন কাজকর্ম সম্পন্ন করে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে, সেজন্য সংঘবদ্ধ অজ্ঞানপার্টি ও ছিনতাইকারী চক্রের বিরুদ্ধে র্যাবের সাড়াঁশি অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান র্যাব-৩ এর সিও।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে রাজধানীর খিলগাঁও থানায় একটি, মতিঝিল থানায় দুটি, পল্টন থানায় চারটি, শাহবাগ থানায় দুটি ও শাহজাহানপুর থানায় দুটি মামলা করেছে র্যাব।