একটা সময় টাঙ্গাইলের চরাঞ্চলকে বলা হতো ‘রক্তাক্ত জনপদ’। যেখানে খুন, লুটতরাজ, জিম্মি ও অপহরণ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। জেলার সদর উপজেলার হুগড়া, কাতুলি, দ্যাইন্যা ও কাকুয়া ইউনিয়ন নিয়ে টাঙ্গাইলের এই চরাঞ্চল যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীবেষ্টিত হওয়ায় সেখানে চরমপন্থী আতঙ্কে দিন কাটাত সাধারণ মানুষ।
এসব এলাকায় কথিত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) ও সর্বহারাসহ নানা চরমপন্থী গোষ্ঠীর উত্থান হয় নব্বইয়ের দশক থেকে। চরাঞ্চলের সাধারণ মানুষের মাঝে স্বস্তি ফেরাতে ২০২০ সাল থেকে কাজ শুরু করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এর অংশ হিসেবে র্যাবের পক্ষ থেকে চরমপন্থীদের পরিবারের সদস্যদের স্বাভাবিক পেশায় পুনর্বাসিত করার লক্ষ্যে তাদের আর্থিকভাবে সচ্ছল করতে নানা কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
বর্তমানে টাঙ্গাইলে ৩০টি সর্বহারা পরিবারের নারী সদস্যদের হস্তশিল্প প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করতে ‘উদয়ের পথে’ নামক একটি পাইলট প্রোগ্রাম চলমান। এই প্রোগ্রামের আওতায় ভূমিহীনদের স্থায়ী বাসস্থানের জন্য ভূমি বরাদ্দের পরিকল্পনাও রয়েছে।
আগামীকাল রোববার (২১ মে) সিরাজগঞ্জ স্টেডিয়ামে র্যাব-১২ এর তত্ত্বাবধানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, রাজবাড়ী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া ও মেহেরপুরসহ দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন চরমপন্থী গোষ্ঠীর মোট ৩২৩ জন সদস্য দুই শতাধিক অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করবেন। এদের মধ্যে শুধু টাঙ্গাইলের চরমপন্থী রয়েছে ৭৬ জন।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার হুগড়া ইউনিয়নের বেগুনটাল এলাকার সাবেক সর্বহারা দলের সদস্য বারেক মিয়া ঢাকা মেইলকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের পুনর্বাসিত করা হয়েছে। এসব দেখেই সর্বহারা দলের অন্য সদস্যরা সম্প্রতি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে শুরু করেছে। রোববার (২১ মে) র্যাব-১২ এর কাছে ৭৬ জন সর্বহারা সদস্য আত্মসমর্পণ করবে বলে জেনেছি।
বেগুনটাল বাজারের ব্যবসায়ী আব্দুর রহিম ও শওকত আলী ঢাকা মেইলকে বলেন, একটা সময় ছিল টাঙ্গাইলের চরাঞ্চলের মানুষ দিনের বেলাতেও স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করতে পারত না। সর্বহারা সদস্যদের আত্মসমর্পণের খবরে আনন্দের জোয়ারে ভাসছে স্থানীয়রা। এ খবরে স্বস্তি ফিরেছে চরাঞ্চলে।
সর্বহারা দলের টাঙ্গাইল জেলার কমান্ডার সদর উপজেলার হুগড়া ইউনিয়নের কাশিনগর গ্রামের জিয়াউর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, আমাদেরকে ভুল বুঝিয়ে নেতারা পথভ্রষ্ট পথে নিয়েছিল। মুখে নীতি কথা বললেও কাজে ছিল পুরো উল্টো। সাধারণ মানুষ আমাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখত। আমার সন্তানরাও এজন্য এলাকায় মুখ দেখাতে পারত না। তাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতেই আমরা ৭৬ সদস্য বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গুলিসহ আত্মসমর্পণ করতে যাচ্ছি।
সর্বহারা দলের সেকেন্ড ইন কমান্ড কালিহাতী উপজেলার পৌলি এলাকার লেবু মণ্ডল ঢাকা মেইলকে বলেন, গতকাল রাতেও আমি আতঙ্কে কাটিয়েছি। সর্বহারা দলের সদস্য হওয়ার পর থেকেই ছেলে-মেয়েদের থেকে দূরে থেকেছি। ডজনখানেক মামলা মাথায় নিয়ে ঘুরছি।
র্যাব-১২ এর অধিনায়ক (সিও) ও অতিরিক্ত ডিআইজি মো. মারুফ হোসেন ঢাকা মেইরকে বলেন, বিভিন্ন চরমপন্থী দলের নেতা ও সদস্যদের বিভিন্নভাবে আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে র্যাব কাজ করে যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে গরুর খামার, পোল্ট্রি ফার্ম, মাছ চাষের ব্যবস্থা, চায়ের দোকান, ভ্যান-রিকশা, সেলাই মেশিন দেওয়ার মাধ্যমে চরমপন্থী সদস্য ও তাদের পরিবারগুলোকে স্বাভাবিক পেশায় স্থানান্তরের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।