ব্যাংকের পাশাপাশি এবার ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিল বাংলাদেশ ব্যাংক। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণে সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ এবং আমানতে ৭ শতাংশ সুদহার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আগামী ১ জুলাই থেকে নতুন, পুরোনো সব ঋণে এ সুদহার কার্যকর হবে। নতুন আমানতের ক্ষেত্রে নির্ধারিত তারিখে এই সুদ নেওয়া হলেও পুরোনো আমানতে মেয়াদ পূর্তির পর থেকে কার্যকর করতে হবে। গতকাল সোমবার এ-সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে ২০২০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ব্যাংকগুলোর ঋণে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদহার নির্ধারিত আছে। সামগ্রিকভাবে আমানতের সুদ নির্ধারণের বিষয়টি তখন ব্যাংকগুলোর ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে ঋণের সুদ কমাতে গিয়ে আমানতের সুদ তলানিতে নামিয়ে আনে অনেক ব্যাংক। কোনো ব্যাংক দুই থেকে তিন শতাংশ সুদে মেয়াদি আমানত নিচ্ছিল। এরকম পরিস্থিতিতে গত বছরের ৮ আগস্ট এক নির্দেশনার মাধ্যমে ব্যক্তি পর্যায়ের মেয়াদি আমানতে গড় মূল্যস্ম্ফীতির কম সুদ না দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রভিডেন্ট ফান্ড, অবসর-উত্তর পাওনা পরিশোধের জন্য গঠিত বিভিন্ন তহবিলের ক্ষেত্রেও গড় মূল্যস্ম্ফীতির বেশি সুদ দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও সুদহার বেঁধে দেওয়া নিয়ে আলোচনা থাকলেও এত দিন এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা ছিল না।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সার্কুলারে বলা হয়েছে, আমানত সংগ্রহ এবং ঋণের সুদহার পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কিছু কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে উচ্চ সুদে আমানত নিচ্ছে। এতে অযৌক্তিকভাবে প্রতিষ্ঠানের তহবিল ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চ সুদে ঋণ দিতে হচ্ছে। তাতে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হ্রাস, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি এবং উৎপাদনসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এরকম প্রেক্ষাপটে আমানত ও ঋণের সুদহার যৌক্তিক করার মাধ্যমে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতের ওপর সুদহার সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ এবং সব ধরনের ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ১১ শতাংশ নির্ধারণ করা হলো।
আগামী ১ জুলাই থেকে এ নির্দেশনা কার্যকর করতে হবে। নির্দেশনা কার্যকরের পর নতুনভাবে নেওয়া সব আমানত এবং বিদ্যমান ও নতুন সব ঋণে এ হারে সুদহার নির্ধারণ করতে হবে। তবে আগে আহরণ করা আমানতের মেয়াদ পূর্তির আগ পর্যন্ত পূর্বঘোষিত সুদহার দিতে হবে। মেয়াদ পূর্তির পর ৭ শতাংশের বেশি সুদ দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমকালকে জানান, ব্যাংকে সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে না করায় বাজারে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এখানে সুদহার নির্ধারিত না থাকায় অনেক প্রতিষ্ঠান ১২ থেকে ১৫ শতাংশ সুদে আমানত নিচ্ছে। এত উচ্চ সুদের আমানত নিয়ে প্রতিষ্ঠান কাকে ঋণ দেবে। যেখানে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে সব কাগজপত্র আছে- এমন কোনো গ্রাহক তো আর ১৮ থেকে ২০ শতাংশ সুদে ঋণ নেবে না। যে কারণে ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও সুদহার নির্ধারণ করে দেওয়া হলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতের গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। আর ঋণে ১০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। একই মাসে ব্যাংকগুলো গড়ে ৪ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ সুদে আমানত এবং ৭ দশমিক ১০ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করেছে। সংশ্নিষ্টরা জানান, ব্যাংকগুলো সব ধরনের আমানত নিতে পারে। তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছয় মাসের কম মেয়াদি কোনো আমানত নিতে পারে না। আবার পরিচিতি কম থাকায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ব্যক্তি পর্যায়ের অনেকে আমানত রাখতে চান না। এসব প্রতিষ্ঠানের আমানতের অন্যতম উৎস ব্যাংক বা বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জালিয়াতির মাধ্যমে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বের করে নেওয়ার তথ্য ফাঁস হয়েছে। এতে সাধারণ আমানতকারীদের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোও এসব প্রতিষ্ঠানে আগের মতো টাকা রাখতে চাইছে না। আমানত টানতে প্রতিষ্ঠানগুলো উচ্চ সুদ অফার করছে।