ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম ভয়াবহ ক্যান্সারে রূপ নিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
আর্থিক খাতের সুশাসন নিশ্চিতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুবই জরুরি মন্তব্য করে তিনি বলেন, দেশের উন্নয়ন নিয়ে আমরা গর্ব করলেও আর্থিক খাতের অনিয়ম নিয়ে কথা বলতে লজ্জাবোধ হয়। মাথা হেইট হয়ে আসে। ঋণ জালিয়াতি ও অর্থপাচারের সংস্কৃতি আমাদের জন্য একটা বড় কালো দাগ।
ব্যাংকিং খাতে সুশাসন জোরদারে ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে শনিবার (৩০ মার্চ) ডিবেট ফর ডেমোক্রেসি অয়োজিত এক ছায়া সংসদ বিতর্ক প্রতিযোগিতায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ব্যাংকিং খাতের অনিয়ম ভয়াবহ ক্যান্সারে রূপ নিচ্ছে। একের পর এক ঋণ কেলেঙ্কারি, অর্থ আত্মসাৎ, রিজার্ভ চুরি, বেসিক ব্যাংকের জালিয়াতি, ফারমার্স ব্যাংকের পতন, পিপলস লিজিংয়ের অবসায়ন, হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ডেসটিনির জালিয়াতি, পুঁজিবাজারের কারসাজি, শেয়ার মার্কেট লুট ইত্যাদি কলঙ্কিত ঘটনা আর্থিক খাতকে ব্যাপক দুর্বল করে ফেলেছে। ব্যাংক খাত আজ তছনছ হয়ে যাচ্ছে। সোনালী ব্যাংক লুট হয়েছে। জনতা ব্যাংক লুট হয়েছে। বেসিক ব্যাংক ধ্বংস হয়েছে। পদ্মা ব্যাংক কলঙ্কের ইতিহাস রচনা করেছে।
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান বলেন, এই বেসামাল পরিস্থিতি উত্তরণে বাংলাদেশ ব্যাংক সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূতকরণ কার্যক্রম শুরু করেছে। তবে ব্যাংক একীভূতকরণের মাধ্যমে আর্থিক খাতের সুশাসন নিশ্চিতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুবই জরুরি। কতিপয় রাজনৈতিক চক্র, স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী যাতে আর আর্থিক খাতে অনিয়ম করতে না পারে তার জন্য সরকারকে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে।
হাসান আহমেদ চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি পদ্মা ব্যাংক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হয়েছে। একীভূত হওয়ার পর রেড জোনে থাকা পদ্মা ব্যাংকের গ্রাহকদের নগদ অর্থ উত্তোলনের পরিমাণ বেড়ে গেছে। অন্যদিকে এক্সিম ব্যাংকের আমানতকারীদের মধ্যেও টেনশন তৈরি হয়েছে। খেয়াল রাখতে হবে পদ্মা ব্যাংকের ভাইরাস যাতে এক্সিম ব্যাংকে সংক্রমিত না হয়। একইসঙ্গে এক্সিম ব্যাংককেও নিজেদের কোনো অনিয়ম থাকলে দ্রুত তা সমাধান করা উচিত। তা না হলে এক্সিম ব্যাংকও পদ্মায় ডুবে যেতে পারে। মনে করা হয় ফারমার্স ব্যাংকে বাঁচতে দিয়ে পদ্মা ব্যাংক হতে দেওয়াটা ছিল বড় ভুল। ফারমার্স ব্যাংকটিকে বন্ধ করে দিলে হয়তো এত বড় আর্থিক ক্ষতি কিছুটা হলেও কম হতো। কিসের ভিত্তিতে ব্যাংক একীভূত করা হচ্ছে, দুর্বল ব্যাংকের দায়-দেনা কে পরিমাপ করবে, দুর্বল ব্যাংকের ক্ষতির দায় কে নেবে, ভালো ব্যাংকটি খারাপ অবস্থায় পড়বে কি না, একীভূত ব্যাংক দুইটি কীভাবে পরিচালিত হবে এগুলো এখন বড় প্রশ্ন?
ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দশ দফা সুপারিশ পেশ করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান। তার সুপারিশগুলো হলো-
১) ব্যাংক থেকে নামে বেনামে অত্মসাৎকৃত অর্থ আদায়ে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে প্রয়োজনে প্রচলিত আইনের সংস্কারের মাধ্যমে অপরাধীদের বিরুদ্ধে বিচারের ব্যবস্থা করা ২) আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিতে স্বাধীন ব্যাংক কমিশন গঠন করা ৩) ঋণ জালিয়াতির সাথে জড়িত ব্যক্তিসহ ঋণখেলাপি ও অর্থ পাচারকারীদের নামের তালিকা জাতীয় সংসদে প্রকাশ করা
৪) আর্থিক খাতে অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিসহ ঋণ খেলাপিদের বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা প্রদান, নতুন ঋণ প্রদান বন্ধ, দেশে বিদেশে স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তির তালিকা করে এনবিআর ও দুদকের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা ও ব্যবসা সম্প্রসারণ প্রদান করা।
৫) শুধু সবল ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত নয়, যারা ব্যাংক দুর্বল করার জন্য দায়ী তাদের চিহ্নিত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। যাতে সরকারের ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়াকালীন এসব অসৎ ব্যক্তিরা পার পেয়ে যেতে না পারে।
৬) দুর্বল ব্যাংকগুলোর ক্ষতির দায় কে নেবে তা স্পষ্ট করা। একইসঙ্গে দুর্বল ব্যাংকগুলোর আমানত গ্রহণ ও বিতরণ ছাড়া অন্যসব কার্যক্রম বন্ধ করা।
৭) দুর্বল ব্যাংকের আদায় অযোগ্য ঋণ আদায়ের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৮) ব্যাংকের কার্যক্রমের ওপর অধিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে কোন অনিয়ম না হয়।
৯) ব্যাংকের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা আলাদা করতে হবে। যাতে মালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী পর্ষদ যেন ব্যবস্থাপনা কাজে হস্তক্ষেপ করতে না পারে।
১০) ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার সুফল পেতে গণমাধ্যমের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করা। যাতে কোনো পক্ষপাতমূলক সংবাদ ব্যাংক একীভূত প্রক্রিয়ায় বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ রইস, ড. এম এম মোর্শেদ, সাংবাদিক দৌলত আক্তার মালা, সাংবাদিক ইকবাল আহসান এবং সাংবাদিক সেলিম মালিক।