তিন যুগের আক্ষেপ ঘুচিয়ে কাতারে সোনালি ট্রফির স্বপ্নপূরণ। বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পায় আর্জেন্টিনা। কার্যত নিজের শেষ বিশ্বকাপ খেলতে নেমে আকাশী-সাদা সমর্থকদের উৎসবের উপলক্ষ্য এনে দেন লিওনেল মেসি। বাঁ পায়ের জাদুতে টুর্নামেন্টজুড়ে মাতিয়ে রেখেছেন। বলা চলে, দলকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে শিরোপা জিতিয়েছেন মেসি। আর্জেন্টাইনদের সাফল্যের পেছনে প্রধান কুশীলব হিসেবেও দেখা হয় তাকে। ফ্রান্সের বিপক্ষে ফাইনালেও ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সে ছিলেন উজ্জ্বল। তবে এতকিছুর পরও আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক হিসেবে মেসিকে মানতে নারাজ নরওয়ের এক গবেষক। তার মতে, ট্রফি জয়ের আসল কৃতিত্ব গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্টিনেজের।
আধুনিক ফুটবলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে পেনাল্টি শুটআউটের ভূমিকা। বিশেষ করে নকআউটের হাই-ভোল্টেজ ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে পেনাল্টি শুটআউটই। মাস তিনেক আগে বিশ্বকাপের ফাইনালেও চ্যাম্পিয়ন দল নির্ধারিত হয়েছে টাইব্রেকারে। কোনো কোনো দলের সাফল্য শুটআউটে খুবই ভাল। এই যেমন ক্রোয়েশিয়ার কথাই ধরা যাক। ধারাবাহিকভাবে সফল তারা। কাতার বিশ্বকাপের কোয়ার্টারেও শক্তিশালী ব্রাজিলকে হারিয়ে দিয়েছে তারা। তবে কিছু দল আছে যারা ধারাবাহিকভাবে শুটআউটে ব্যর্থ। গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে শুটআউট হলে কীভাবে সাফল্য পাওয়া সম্ভব? কারণ জানতে গবেষণা করেছিলেন নরওয়ের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক জেয়ার জর্ডেট। তার মতে, দুই দলের পার্থক্য গড়ে দেয় মানসিকতা।
তবে শুধু জয়ের তাড়না কিংবা সাফল্য পেতে উদগ্রীব থাকার মানসিকতা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অনেক কিছুই। মাঠ এবং তার বাইরের বিভিন্ন জিনিস, বিভিন্ন ঘটনা প্রভাবিত করে ফুটবলারদের। নেতিবাচক বা ইতিবাচক, দুই দিকেই তার ফল পাওয়া যায়। কেউ ভেতরে ভেতরে নার্ভাস হয়ে পড়েন। আবার কেউ উত্তেজনায় ফুটতে থাকেন। ফলে গোল করা বা নষ্ট করার পেছনে তার প্রভাব থাকে। নিজের গবেষণায় সেই দিকগুলোই তুলে ধরেছেন গবেষক জেয়ার জর্ডেট।
তার গবেষণায় উঠে এসেছে বিশ্বকাপ ফাইনাল প্রসঙ্গও। জর্ডেটের মতে, শুটআউটের সময় ম্যাচের গতিপ্রকৃতি গোলকিপারের থেকে বেশি কেউ প্রভাবিত করতে পারেন না। তিনি জানিয়েছেন, ফাইনালে আর্জেন্টিনা এবং ফ্রান্সের মধ্যে যদি আসল পার্থক্য কেউ গড়ে দিয়ে থাকেন, তিনি এমিলিয়ানো মার্টিনেজ। বিশ্বকাপের সময় এবং পরে যিনি বিভিন্ন কারণে বিতর্কিত চরিত্র হয়ে উঠেছেন। ফলে ফাইনালে জোড়া গোল করা মেসি নয়, ট্রফি জয়ের আসল কৃতিত্ব মার্টিনেজের বলেই মনে করছে গবেষণা।
নিজের গবেষণায় মার্টিনেজকে ‘ফুটবলের ম্যাকিয়াভেলি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন জর্ডেট। শুটআউটের সময় বিশেষ করে মার্টিনেজের আচরণের কথা তুলে ধরেছেন তিনি। ফাইনালের বিশ্লেষণ করার আগে জর্ডেট উল্লেখ করেছেন ২০২১ সালের কোপা আমেরিকার সেমিফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে শুটআউটের কথা। সেই ম্যাচে উল্টোপাল্টা কথা বলে বিপক্ষের নজর ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মার্টিনেজ।
ম্যাচটি হয়েছিল রুদ্ধদ্বার স্টেডিয়ামে। ফলে মাইক্রোফোনে স্পষ্ট শোনা গিয়েছিল মার্টিনেজের কথাবার্তা। যিনিই শট নিতে আসছিলেন, তাকে উদ্দেশ্য করে মার্টিনেজ বলছিলেন, আমি জানি তুমি নার্ভাস। জানি কোন দিকে তুমি শট নেবে। দেখো কীভাবে আমি শট বাঁচিয়ে দেই। মনে রেখো, আমি তোমার শট বাঁচাবই। বিশ্বকাপ ফাইনালে মার্টিনেজের আসল চেহারা দেখা যায়। শুটআউটের সময় পেনাল্টি বক্সকে নিজের এলাকা বানিয়ে ফেলেছিলেন। পণ করেছিলেন, সেখানে তিনি দুর্ভেদ্য হয়ে উঠবেন।
ফ্রান্সের ফুটবলারদের প্রথম থেকেই বিক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। ফ্রান্সের প্রথম দুটি শটের সময় রেফারিকে বার বার বলছিলেন, বল ঠিক জায়গায় রাখা হয়েছে কি না দেখতে। এ ধরনের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ফুটবলারের ফোকাস নড়ে যায়। সেই ফুটবলার রেফারিকেও দুষতে থাকেন। কিংসলে ক্যোমানের দ্বিতীয় পেনাল্টি সে ভাবেই বাঁচিয়ে দেন মার্টিনেজ। তারপরে চিৎকার করে উচ্ছ্বাস করতে থাকেন।
সাধারণত গোলকিপাররা এভাবে উচ্ছ্বাস করেন না। তবে জর্ডেট গবেষণা করে দেখেছেন, উচ্ছ্বাস মাত্রা ছাড়ালে পরবর্তী ঘটনাক্রমে তা প্রভাব ফেলে। জর্ডেট বলেছেন, ‘পেনাল্টিতে গোল করে যেসব ফুটবলার বেশি উচ্ছ্বাস করে, সেই দলের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কোনও ফুটবলার বেশি উচ্ছ্বাস করলে পরবর্তী ফুটবলারের মিস্ করার সম্ভাবনা ১০-১৫ শতাংশ। এবং যে ফুটবলার বাড়তি উচ্ছ্বাস করেছেন, তাঁর সতীর্থদের গোল করার সম্ভাবনা ৭-৮ শতাংশ বেড়ে যায়।”
ফাইনালে ফ্রান্সের চুয়ামেনি কিক নিতে আসার সময় মার্টিনেজের হাতে বল ছিল। তিনি আর্জেন্টাইনদের উদ্দেশে ইঙ্গিত করে আরও বেশি চিৎকার করতে বলছিলেন। রেফারি বল চাইলে মার্টিনেজ সেটি ৪৫ ডিগ্রি কোণে ছুড়ে দেন। চুয়ামেনিকে গিয়ে সেই বল ধরতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যদি কোনো ফুটবলারকে শট নেওয়ার আগে অপেক্ষা করতে হয়, তার গোল করার সম্ভাবনা ২০-৩০ শতাংশ কমে যায়। ফলে চুয়ামেনিও শট মিস করেন।
মার্টিনেজ জানতেন যে, তিনি যে পদ্ধতি নিয়েছেন, বিপক্ষ গোলকিপার হুগো লরিসও সেটাই করতে পারেন। তাই চুয়ামেনির শটের পরেই বল নিয়ে নিজেই সতীর্থ লিয়ান্দ্রো পারেদেসের হাতে তুলে দেন। সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনার চার ফুটবলারই গোল করেছিলেন। মার্টিনেজ সম্পর্কে জর্ডেট লিখেছেন, খুব হিসেবি, সৃষ্টিশীল একটা চরিত্র।
গত ২০ বছর ধরে প্রতিটি বিশ্বকাপের সব পেনাল্টি শুটআউট দেখেছেন জর্ডেট। দুশটিরও বেশি শট বিশ্লেষণ করেছেন। দুই হাজার কিক দেখেছেন। শুটআউটের সময় ফুটবলারদের মানসিকতা, আচার-আচরণ এবং চলাফেরা খুঁটিয়ে দেখেছেন তিনি। অতীতে ইংল্যান্ডের সাবেক গোলকিপার পিটার শিল্টন বলেছিলেন, পেনাল্টি হল ভাগ্যের ব্যাপার। জর্ডেট তা মানতে রাজি নন। তার মতে, পেনাল্টির পেছনে জড়িয়ে আচে বিজ্ঞান। সে জন্যই সাফল্য এবং ব্যর্থতার বিভেদ ক্রমশ কমছে। ২০২১-এ অলিম্পিক্সে পুরুষ এবং মহিলা বিভাগে জয়ী দুই দলই ফাইনালে সাফল্য পেয়েছিল শুটআউটে। বিশ্বকাপের আগে কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনা এবং ইউরো কাপে ইতালি জিতেছে শুটআউটে।
পরের বছরে আফ্রিকান কাপ অফ নেশন্সে সেনেগাল, ইংলিশ কাপে চেলসির বিপক্ষে দু’বার লিভারপুল জিতেছে শুটআউটে। একই ভাবে স্প্যানিশ এবং জার্মান কাপ জিতেছে রিয়াল বেতিস এবং আরবি লাইপজিগ। ইউরোপা লিগে ফ্রাঙ্কফুর্ট হারিয়েছে রেঞ্জার্সকে। কাতার বিশ্বকাপে রেকর্ড সংখ্যক পাঁচটি শুটআউট দেখা গেছে।
দল বা দেশের পরিসংখ্যান বের করতে গিয়ে জর্ডেট দেখিয়েছেন, ইংল্যান্ড ১০ বারের মধ্যে ৭ বার হেরেছে। নেদারল্যান্ডস আটটির মধ্যে সাতটি হেরেছে। স্পেন শেষ চার বারই হেরেছে। অন্যদিকে, আর্জেন্টিনা শেষ তিন বার, ক্রোয়েশিয়া শেষ চারবার এবং জার্মানি শেষ ছটি শুটআউটে জিতেছে। কোনো দল যদি পরিসংখ্যানে পিছিয়ে থাকার কথা মাথায় রেখে শুটআউটে নামে, তাদের ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। একই ভাবে, অতীতে সাফল্য থাকলে ভবিষ্যতেও সাফল্য মিলবে।
জর্ডেটের মতে, যত দিন যাবে, ততই পেনাল্টির গুরুত্ব বাড়বে। পেনাল্টির ক্ষেত্রে সাহায্য চেয়ে ইতোমধ্যেই জর্ডেটের কাছে আবেদন করেছে ২০টি ক্লাব। তাদের সাধ্যমতো সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন তিনি।