রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি, রেমিট্যান্সের গতিও কম। বাড়তি চাহিদার কারণে বাড়ছে মার্কিন ডলারের দাম। এতে মান হারাচ্ছে দেশীয় মুদ্রা টাকা। সবশেষ গতকাল বুধবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ২০ পয়সা বেড়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় উঠেছে ডলারের দাম। তবে খোলাবাজার ও নগদ মূল্যে ডলার আরও বেশি দামে (৯১ থেকে ৯২ টাকায়) কেনাবেচা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করেও দামের এ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা ঠেকাতে পারছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে প্রবাসীদের পাঠানো আয় বা রেমিট্যান্স গত তিন মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে কমছে। আবার প্রত্যাশা অনুযায়ী আসছে না রপ্তানি আয়। অন্যদিকে করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় দেশে আমদানির চাপ বেড়েছে। এর দায় পরিশোধে বাড়তি ডলার লাগছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এসব কারণে টাকার বিপরীতে বাড়ছে ডলারের দাম।
এছাড়া করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় অনেকে বিদেশ ভ্রমণ করছেন। দেশে থাকা অনেক প্রবাসী এখন বিদেশে নিজ নিজ কর্মস্থলে যাচ্ছেন। এর কারণে নগদ ডলারের চাহিদা বেশি থাকায় খোলাবাজরেও দাম বাড়ছে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, দীর্ঘদিন স্থিতিশীল থাকার পর গত বছরের আগস্টে হঠাৎ টাকার বিপরীতে বাড়তে শুরু করে ডলারের দাম। যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। এর আগে ২০২০ সালের জুলাই থেকেই ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় স্থিতিশীল ছিল ডলার। ২০২১ সালের আগস্টের শুরুতেও আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলারের মূল্য একই ছিল। এরপর ৩ আগস্ট থেকে দু-এক পয়সা করে বাড়তে বাড়তে গত ২২ আগস্ট প্রথমবারের মতো ৮৫ টাকা ছাড়ায়। এরপর এ বছরের ৯ জানুয়ারিতে এটি বেড়ে ৮৬ টাকায় পৌঁছে। এরপর ২২ মার্চ পর্যন্ত এ দরেই স্থির ছিল। পরে গত মঙ্গলবার আন্তঃব্যাংকে আরও ২০ পয়সা বেড়ে হয়েছে ৮৬ টাকা ২০ পয়সা। অর্থাৎ গত সাড়ে ৭ মাসে দর বেড়েছে এক টাকা ৪০ পয়সা বা এক দশমিক ৬৫ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা মজুত রয়েছে। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ব্যাংকগুলোর কাছে চাহিদার বিপরীতে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যখন বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বেশি ছিল তখন ডলার কিনেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এখন সরবরাহ কমে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ডলার বিক্রি করছে। সবশেষ ২৩ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের চাহিদার বিপরীতে ৩৭৮ কোটি ডলার বিক্রি করেছে নিয়ন্ত্রণ সংস্থা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, করোনার শুরুর দিকে প্রবাসী আয়ের চাঙাভাব থাকলেও গত বছরের জুন থেকে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সবশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে প্রবাসীরা ১৪৯ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন, যা গত ২১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এছাড়া ফেব্রুয়ারিতে পাঠানো প্রবাসী আয়ের এ অংক আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১৬ শতাংশ কম।
একইভাবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে রপ্তানি আয় হয়েছে ২ হাজার ৭৯৮ কোটি ডলার। এর বিপরীতে আমদানি বাবদ খরচ হয়েছে চার হাজার ৬৬৭ কোটি ডলার। আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে রপ্তানি বেড়েছে ২৯ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং আমদানি বেড়েছে ৪৬ দশমিক ২৩ শতাংশ। এসব কারণে ডলারের চাহিদা বাড়ছে।
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো চাইলেও বাড়তি ডলার নিজেদের কাছে রাখতে পারে না। বৈদেশিক মুদ্রা রাখার বিষয়ে প্রতিটি ব্যাংকের নির্ধারিত সীমা আছে, যাকে এনওপি বা নেট ওপেন পজিশন বলে। যদি কোনো ব্যাংকে নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত ডলার মজুত থাকে তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ডলার বিক্রি করতে হয়। আর না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে বিক্রি করতে হবে। কেউ নির্ধারিত সীমার বাইরে ডলার নিজেদের কাছে ধরে রাখলে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে জরিমানা গুনতে হয়। জরিমানার হাত থেকে বাঁচার জন্য ব্যাংকগুলো বাজারে ডলার বিক্রি করতে না পারলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, একটি ব্যাংক তার মূলধনের ১৫ শতাংশের সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিজেদের কাছে ধরে রাখতে পারে। এর অতিরিক্ত হলেই তাকে বাজারে ডলার বিক্রি করতে হবে।
এদিকে ডলারের দাম বাড়ায় প্রভাব পড়েছে পণ্য আমদানিতে। বাংলাদেশ খাদ্য সামগ্রী আমদানি ও সরবরাহকারী সমিতির (বিএএফআইএসএ) সাধারণ সম্পাদক ও মাওলা ট্রেডার্সের চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৮৬ টাকা ২০ পয়সা বললেও আমদানি এলসি করতে আমাদের কাছ থেকে ৮৬ টাকা ৭০ থেকে ৮০ পয়সা নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। এতে খাদ্যপণ্য আমদানিতে ব্যয় বেশি হচ্ছে বলে জানান তিনি।