আমাদের এক ও অদ্বিতীয় হুমায়ুন ফরীদি — প্রখ্যাত টিভি নাটক নির্মাতা আতিকুল হক চৌধুরী একবার অভিনয়ের জন্য এক তরুণকে দেখে দারুণ পছন্দ করলেন। ভাবলেন তার পরবর্তী নাটক “নিখোঁজ সংবাদে” সেই তরুণকে চাই। তরুণটিকে আতিকুল হক চৌধুরী ডাকলেন। প্রথমে জিজ্ঞেস করলেন, অভিনয় করবে টিভি নাটকে? . তরুণ বললো, ‘নিশ্চয়ই। কেন করবো না!’ আতিকুল চৌধুরী বললেন ‘ঠিক আছে এমন এমন হবে নাটক, এটা তোমার চরিত্র। এভাবে অভিনয় হবে।’ . আতিকুল হক চৌধুরীর বলা শেষ হওয়ার আগেই তরুণটি বললো, ‘না এই নাটকটি আমি করবো না। এই নাটকটি করা আমাকে দিয়ে হবে না।’ আতিকুল হক চৌধুরী বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে পারছিলেন না। তার মুখের ওপর বিখ্যাত অভিনেতারাও এভাবে কথা বলতে পারেন না, বলার সাহসও রাখেন না। তখন তিনি টেলিভিশনে দুঁদে ও খ্যাতিমান নাট্যকার। তার পরিচালিত নাটকে অভিনয় করার জন্য অভিনয়শিল্পীরা মুখিয়ে থাকেন।
সেখানেই কিনা এই ছোড়া বলছে অভিনয় করবে না! এই সুযোগ কেও হেলায় ছাড়ে! . তারপর তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে তাহলে তুমি অডিশন দাও।’ তরুণের সাফ জবাব, ‘আমি অডিশনও দিতে পারবো না’। এবার যেন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন আতিকুল হক চৌধুরী। তিনি এবার কৌতূহলবশত ও বিস্ময়ের সঙ্গে জানতে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন করবে না?’ . তরুণটি বললো, ‘চরিত্রটা পছন্দ হয় নাই।’ আতিকুল হক চৌধুরী বললেন, ‘করো, তুমি ভালো করবে।’ ‘যে চরিত্রের সাথে আমি নিজেকে রিলেট করতে পারি না, সেটা আমি করবো না,’ বললো সে তরুণ। . ‘আচ্ছা স্ক্রিপ্টটা পড়ো, দেখো ভালো লাগবে।’ আতিকুল হক চৌধুরীর অনুরোধ। স্ক্রিপ্টটা পড়ে তরুণ এবার বললো, ‘আতিক ভাই দুঃখিত আমি এই কাজটা করবো না। যে কাজটি আমার পছন্দ হয়নি, সেটা আমি যতোই ভালো করি তা কখনোই ভালো হবে না।’ . পরে কেবল ওই তরুণের জন্যই নাটকের ওই চরিত্রটি পরিবর্তন করা হয়। পরিবর্তনের পর কাজ করলেন ওই তরুণ অভিনেতা।
সেই তরুণ অভিনেতা বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয়কে নিয়ে গেছেন গগনচুম্বী উচ্চতায়। তখনকার সময় সবচেয়ে জনপ্রিয় সুপারস্টারদের থেকে তার জনপ্রিয়তা ছিল বেশি। বহু চলচ্চিত্র গড়ে উঠেছে কেবল তাকে কেন্দ্র করে। অথচ বেশিরভাগ চলচ্চিত্রে তিনি ভিলেনের চরিত্রে। শ্যুটিং স্পটে অব্দি নায়ক কিংবা মূল চরিত্র থেকে তার প্রতিই সবার নজর। অভিনয়ের সমস্ত ধারা উপধারা ব্যাকরণ ভেঙে দিয়ে নতুন করে অভিনয়ের নিজস্ব ধারার স্রষ্টা তিনি। যাকে নিঃসন্দেহে বলা যায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ অভিনেতা। কিংবদন্তি অভিনয়শিল্পী হুমায়ুন ফরীদি। . হুমায়ুন ফরীদির জন্ম ১৯৫২ সালের ২৯ মে ঢাকার নারিন্দায়। তার বাবা এটিএম নূরুল ইসলাম ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী, আর মা বেগম ফরিদা ইসলাম। চার ভাই-বোনের মধ্যে ফরিদী ছিলেন দ্বিতীয়। ফরিদীর বাবা ছিলেন শিল্পানুরাগী।
গ্রামে নবাব সিরাজউদ্দৌলা নাটকে অভিনয় করেছিলেন তিনি। সরকারি চাকরিজীবী হওয়ার কারণে তার বাবার ছিল বদলির চাকরি। ১৯৬৫ সালে মাদারীপুরের ইউনাইটেড ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন ফরিদী। সেই স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থাতেই ১৯৬৭ সালে “মুখোশ যখন খুলবে” নাটকের মধ্য দিয়ে মঞ্চে অভিষেক হয় হুমায়ুন ফরীদির। . সেই নাটকটি সেই মফস্বল শহরে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। এরপর তাকে চোখে পড়ে মাদারীপুরের নির্দেশক বাশার মাহমুদের। তিনি তাকে তার দল শিল্পী নাট্যগোষ্ঠীতে নিয়ে আসেন। সেখানেই কল্যাণ মিত্রের ‘ত্রিরত্ন’ নাটকে ‘রত্ন’ চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মঞ্চে অভিষেক হয় তার। ওই দলের হয়ে ‘টাকা আনা পাই’, ‘দায়ী কে’, ‘সমাপ্তি’, ‘অবিচার’সহ মোট ৬টি নাটকে অভিনয় করেছিলেন ফরীদি। এর মধ্যে তার বাবা বদলী হয়ে গেলেন চাঁদপুরে।
তাই হুমায়ুন ফরীদিকেও চাঁদপুরে চলে আসতে হলো। ১৯৬৮ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেয়ার পর বাবার চাকরির কারণে চাঁদপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হলেন ফরীদি। সেখানে ১৯৭০ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার কয়েক মাস পর শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। এর মধ্যে চাঁদপুরে একটি দলের হয়ে অভিনয় করছেন, আর তখনই শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। সে সময় সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। . মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তারা যারা অভিনয় করতেন তারাই একটি যাত্রার দল গঠন করেছিলেন। ফরীদির মতে তার ভাবনা যুদ্ধপরবর্তী পর্যায়ে যে ধরনের স্বপ্ন ছিল বা যা একজন মানুষ আকাঙ্ক্ষা করতে পারে সেটি যখন প্রতিফলিত হয়নি সমাজে, সংসারে, রাজনীতিতে, তরুণ বয়সের একগুয়েমি থেকেই যাত্রার দল গঠন করা। . সেবার এক মৌসুম দুইটি নাটক নেমেছিল যাত্রায়। সেখানে দোর্দণ্ড প্রতাপে অভিনয় করেছিলেন ফরীদি।
একটা পর্যায়ে দেড় বছরের মাথায় সেই দলটা ভেঙে গেল। ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ফরীদির ছাত্রজীবনে প্রায় ৫ বছর বিরতি পড়েছিল। সে সময় ঘুরে বেড়ানোই একমাত্র কাজ ছিল ফরীদির। . একটা সময় তিনি ভাবলেন, এভাবে তো চলে না। পড়াশোনা তো করতে হবে। নয়তো এভাবে জীবন নষ্ট হবে। তখন পরিবার তার উপর পুরোপুরি হাল ছেড়ে দিয়েছে। তাদের ধারণা ছেলে বিপথে চলে গেছে, ওকে ফেরানো আর সম্ভব না। এক পর্যায়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তার কিছু বন্ধু ছিল। সেই বন্ধুদের সহায়তায় ভর্তি হলেন। ভর্তি হওয়ার পেছনে আরেকটি অন্যতম কারণ ছিল ফরীদি ভালো ক্রিকেট খেলতেন। অবশেষে জাহাঙ্গীরনগরে ফরীদি বিশেষ বিবেচনায় ভর্তি হলেন অর্থনীতি বিভাগে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি থাকতেন আল- বেরুনী হলে। . জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়ে একবার আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলো। সেখানে তার নাটক প্রথম স্থান অধিকার করলো। মজার বিষয় হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার আগে চার বছরের বেশি সময় ধরে অভিনয় থেকে দূরে ছিলেন তিনি। সেই আন্তঃহল নাট্য প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু ফরীদিকে বললেন, ‘আমাদের ঢাকা থিয়েটার নামে একটি নাটকের দল আছে। তুমি যদি চাও আমাদের সাথে কাজ করতে পারো। একদিন আসো দেখো কেমন লাগে তোমার।’ . তো একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ঢাকা থিয়েটারের মহড়া দেখতে গেলেন ফরীদি। তখন সেলিম আল-দিনের শকুন্তলা নাটকের মহড়া চলছে। শকুন্তলা ছিল অসম্ভব