আমার একমাত্র ছেলে ছিল সাদ। বড় ইচ্ছে ছিল ছেলে কুরআনের হাফেজ হবে, এ জন্য স্কুলে ভর্তি না করে মাদরাসায় দিয়েছিলাম। দুই পাড়া কুরআন মুখস্থও করেছিল, কিন্তু আমাদের সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। আমার ছেলের তো কোনো অপরাধ ছিল না, তাহলে পুলিশ কেন গুলি করল। আমাকে সব দিলেও আর আমি ছেলেকে ফিরে পাবো না।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন পুলিশের গুলিতে নিহত ১৪ বছরের শিশু সাদ মাহমুদের বাবা বাহাদুর খান। গত ২০ জুলাই বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে ঢাকার সাভারে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ দেখতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সাদ।
মানিকগঞ্জের সিংগাইরে সাদের গ্রামের বাড়িতে কথা হয় তার বাবা বাহাদুর খানের সঙ্গে। বাহাদুর প্রশ্ন রাখেন—আমার ছেলে হত্যার বিচার কার কাছে চাইবো?
এভাবে যেন আরও সন্তান পুলিশের গুলিতে মারা না যায় সে প্রার্থনাও করেন তিনি।
সাদ তার বাবা-মায়ের সঙ্গে সাভারের শাহীবাগ এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতো। ২০ জুলাই শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশের যখন সংঘর্ষ শুরু হয় সাদ তখন বাসার ছাদে ফুফাতো ভাইয়ের সঙ্গে খেলা করছিল। ছাদ থেকেই তারা রাস্তায় ধোঁয়া দেখতে পায়। সেই দৃশ্য দেখতে নিউমার্কেট এলাকায় যাওয়ার পরপরই গুলি এসে লাগে সাদের শরীরে। স্থানীয়রা তাকে এনাম মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা ১৪ বছরের শিশু সাদকে মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসকরা জানান, হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যায় সে।
মানিকগঞ্জের গ্রামে না থেকে সন্তানদের লেখাপড়ার জন্যই বাহাদুর খান পরিবার নিয়ে সাভারের শাহীবাগ এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। স্ত্রী-তিন সন্তান নিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবার তার। তিন সন্তানের মধ্যে একমাত্র ছেলে ছিল সাদ। বড় মেয়ে তাসলিমা খানম নাজনীন (২০) সাভারে গণবিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মাসি বিভাগের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। সাদ সাভারের শাহীবাগ এলাকায় জাবালে নূর দাখিল মাদ্রাসায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তো। ছোট মেয়ে আফরোজা খানম নুসরাত (৮) একই মাদরাসার শিক্ষার্থী।
সিংগাইর উপজেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে ধল্লাপাড়া গ্রামে সাদদের বাড়ি গিয়ে এক করুণ দৃশ্য চোখে পড়ে। বাড়ির ভেতরে আধাপাকা টিনের ঘর, ঘরের সামনে উঠানে একটি চেয়ারে নির্বাক হয়ে বসেছিলেন সাদের বাবা বাহাদুর খান। ছেলে হারানোর বেদনা তার শরীর জুড়ে।
বাহাদুর খান বলেন, সেদিন বিকেলে ছেলেকে ছাদে না পেয়ে বাইরে গিয়ে খোঁজ-খবর করি। এক সময় দেখি সড়কে ছেলের জুতা পড়ে আছে, কিন্তু আমার কলিজার ধন নাই। পরে লোকজনের মাধ্যমের জানতে পারি ছেলেকে এনাম মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে গেছে। হাসপাতালে গিয়ে দেখি আমার কলিজার টুকরা আর নেই, লাশ হয়ে পড়ে আছে।
হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে জানান, হাসপাতালে নেওয়ার আগেই সাদ মারা যায়। তার বাম পায়ের উরুতে গুলি লেগে বিশাল ছিদ্র হয়। ছেলে হারানোর এসব কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন সাদের বাবা।
একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে কান্নাকাটি করতে করতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সাদের মা হালিমা আক্তার। কথা বলতে পারছেন না, অনেকটা নির্বাক হয়ে গেছেন।
২০ জুলাই রাতেই সাদের লাশ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। ২১ জুলাই সকালে ধল্লা গ্রামের কেন্দ্রীয় কবরস্থানে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।