আমরা কতবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে কান্না করে সরকারকে বলবো যে, আমার বাবা গুম হয়ে গেছে। আমার বাবাকে খুঁজে বের করে দিন। আমাদের জীবনে হাসি নেই। দিন যায়, রাত আসে। সর্বক্ষণ থাকি বাবার অপেক্ষায়। এই বুঝি দরজায় কড়া নেড়ে বাবা ডাকছে, ইনসা আমি এসেছি মামণি। দরজা খোলো। প্রধানমন্ত্রীও বাবা হারিয়েছেন। তিনি কি বোঝেন না, বাবা হারানোর কষ্ট। আর কত আমরা আর্তনাদ করবো।
কত মানুষের দ্বারে দ্বারে ফরিয়াদ করবো যে, বাবাকে ফিরিয়ে দেন, বাবাকে ফিরিয়ে দেন। আমরা আমাদের মানুষকে ফেরত পাচ্ছি না। রাজধানীর শাহবাগে মায়ের ডাক ও নাগরিক ঐক্য আয়োজিত মানববন্ধনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিল নিখোঁজ ইসমাঈলের মেয়ে ইনসা জামান।
এ সময় মানববন্ধনে আসা অনেকেই তার কথা শুনে চোখের পানি আটকাতে পারেননি। বিএনপি’র ঢাকা মহানগরের নিখোঁজ নেতা চৌধুরী আলমের মেয়ে মাহফুজা আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার বাবাকে যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হয় আমি তখন ছোট ছিলাম। এখন বড় হয়েছি। আমার বাবাকে আমি প্রতিদিন স্বপ্নে দেখি। আমরা আর কত কাঁদবো। আমার বাবাকে ১২ বছর আগে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। টেনে-হিঁচেড়ে গাড়িতে তোলা হয়েছে। যারা ধরে নিয়ে গেছে তারা বলেছে যে, তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোক। আমরা তাদের কাছে ধরনা দিচ্ছি যে, আমার বাবাকে ফিরিয়ে দাও। কিন্তু, আমার বাবার তারা সন্ধান দিচ্ছে না।
মানববন্ধনে ৫৫টি গুম হওয়া পরিবারের সদস্যরা অংশগ্রহণ করেন। পরিবারের সদস্যরা গুম হওয়া ব্যক্তিদের ছবি হাতে মানববন্ধনে অংশ নেন। অনেকেই তাদের ছবি তুলে ধরে শুধু কাঁদছিলেন।
অনুষ্ঠানে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, দেশে এখন আইয়ামে জাহিলিয়াতের মতো অবস্থা বিরাজ করছে। এখানে মানবতা এবং মানবিক মর্যাদার কোনো স্থান নেই। আমরা এমন এক সরকারের আমলে বাস করি যে, কেঁদে মরে গেলেও তারা কোনো কথা শোনে না। আজ এখানে গুম হওয়া পরিবারের সদস্যরা আহাজারি করছেন। কিন্তু, তাদের কান্না তাদের কানে পৌঁছাবে না। তারা এই কান্না নিয়েও তামাশা করে।
তিনি আরও বলেন, জাতিসংঘ থেকে ৬৪ জনের নাম প্রকাশ করে একটি তালিকা প্রকাশ করা হলো। জাতিসংঘ বললো যে, এই সব ব্যক্তি বাংলাদেশের সমাজ-সংগঠনে নেই। তারা নিখোঁজ হয়েছে। তাদের খুঁজে পাচ্ছে না তাদের পরিবারের সদস্যরা। তারা এও বলেছে যে, তাদের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জড়িত রয়েছে বলে ভিকটিমের পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেছেন। কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই গুম হওয়া সদস্যদের নিয়ে কী অদ্ভূত তথ্য দিলেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিরা বিদেশ পালাতে গিয়ে সাগরে সলিল সমাধি হয়েছেন। এটাকে কী মিথ্যাচার বলা যায়। এটা মিথ্যাচার নয়। এটা মানুষের আহাজারিকে নিয়ে তামাশা করা।
তিনি আরও বলেন, যারা মানুষের কষ্টকে নিয়ে তামাশা করে তাদের কাছে কোনো আবেদন করে লাভ নেই। এখানে একজন উপস্থিত হয়ে বলেছেন যে, তার চৌদ্দপুরুষ আওয়ামী লীগ করে। তার বাবা ও চাচা মুক্তিযোদ্ধা। তারপরেও তিনি গুমের শিকার হয়েছেন।
মাহমুদুর রহমান মান্না আরও বলেন, সামনে ২৫শে জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হবে। অথচ কিছুদিন আগেই আমরা শুনেছি যে, ডিসেম্বরে পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হবে। এই সেতু নিয়ে মন্তব্য করতে চাই যে, এখানে কত টাকা চুরি চামারি হয়েছে। শুধু বলতে চাই যে, যে পদ্মা সেতু ডিসেম্বরে উদ্বোধনের কথা সেই সেতু তড়িঘড়ি করে এখন ২৫শে জুন উদ্বোধন করা হচ্ছে। আমার এখন সরকারের কাছে আহ্বান থাকবে যে, পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের জন্য যে তড়িঘড়ি করা হলো এমন ভাবে গুম পরিবারের সদস্যদের যাতে ২৫শে জুন হওয়ার আগেই তাদের পরিবারের সদস্যদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হোক।
অনুষ্ঠানে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি ফাইজুল হাকিম লালা বলেন, দেশের মানুষ যাতে শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলতে না পারে এজন্য অনেককেই গুম করা হয়েছে। সমাজে ভীতি ছড়ানোর জন্য মানুষের প্রতিবাদ স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য গুমের সংস্কৃতি চালু করেছে সরকার। তারা নিরলজ্জভাবে এই জঘণ্য কাজে জনগণের রক্তঘামে উপার্জিত অর্থে লালিত-পালিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করছে।
তিনি আরও বলেন, ২০১৯ সালে মাইকেল চাকমাকে গুম করা হয়েছে। এখনও তার পরিবার তাকে ফিরে পাইনি। মাইকেল চাকমার মা কাঁদতে কাঁদতে অন্ধ হয়ে গেছে। মাইকেল চাকমার অপরাধ কি ছিল? তার অপরাধ ছিল যে, তিনি পার্বত্য জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে কথা বলতেন। তিনি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যাতে সরকারের সকল সুযোগ- সুবিধা পায় তার কথা বলতেন। এজন্য তাকে গুম করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ৭২ থেকে ৭৫ সালে আমরা দেখেছি যে, ভিন্নমতকে দমন করতে রক্ষী বাহিনীর সদস্যরা কীভাবে জাসদ ও গণবাহিনীর সদস্যদের হত্যা ও নির্যাতন করেছে। এই সরকার আমাদের কান্না শুনবে না। সরকারের পতন ঘটিয়ে মেহেনতি ও নির্যাতিত মানুষের অধিকার আদায় করতে হবে।
অনুষ্ঠানে গুম হওয়া কাওসারের ছোট মেয়ে লামিয়া, রামপুরার ছাত্রলীগের নেতা টিপুর মা এবং বাপ্পীর বোন ঝুমুর বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসা।