১৯৯৮ সালে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যার মধ্য দিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন তিনি। এরপর একসঙ্গে তিনজনকে হত্যাসহ চারটি হত্যার অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া রয়েছে হত্যাচেষ্টা, হামলা, দখল, চাঁদাবাজির বিস্তর অভিযোগ। তিনি হলেন ফারুক সরকার আব্বাসী, ভাওরখোলা ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান। সর্বশেষ গত মাসে আব্বাসীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বীর বাড়িতে হামলা চালিয়ে ওই পরিবারের এক নারীকে হত্যার অভিযোগ ওঠে। পুলিশ এখনো তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান হয়েছিলেন আব্বাসী। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলছেন, দলে আব্বাসীর কখনোই কোনো পদ ছিল না। তিনি কী করে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন পান, তা নিয়ে তখন সবাই বিস্মিত হয়েছিলেন। কার শেল্টারে আব্বাসী চলেন, তা স্পষ্ট নয়। তবে তাঁর কর্মকাণ্ডে স্থানীয় নেতা-কর্মীরাও বিব্রত। আব্বাসীর কর্মকাণ্ড নিয়ে ভাওরখোলা গ্রামের অনেকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে ফারুক আব্বাসী ঢাকার হাজারীবাগে ট্যানারিতে কাজ করতেন। সেখান থেকেই অপরাধজগতে পা রাখেন।
১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানীর ট্রাম্পস ক্লাবে খুন হন চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী। ওই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন আব্বাসী। ১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই ওই মামলার অভিযোগপত্র দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। অভিযোগপত্রে আলোচিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ নয়জনকে আসামি করা হয়। ফারুক আব্বাসীর নাম রয়েছে দুই নম্বরে। মামলার অন্য আসামিরা হলেন ট্রাম্পস ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম, আশীষ চৌধুরী এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম (ইমন), আদনান সিদ্দিকী, তারিক সাঈদ মামুন, সেলিম খান ও হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন। ওই মামলার তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, হাজারীবাগকেন্দ্রিক অপরাধী চক্রের মাধ্যমে ‘শুটার’ হিসেবে সোহেল চৌধুরী হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন ফারুক আব্বাসী। উচ্চ আদালত আসামিদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। ২৩ বছরেও মামলার বিচারকাজ শুরুই হয়নি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় কিছুদিন কারাগারে ছিলেন আব্বাসী। এরপর জামিনে বেরিয়ে আব্বাসী ফিরে আসেন নিজ বাড়ি ভাওরখোলা গ্রামে। গ্রামে গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী বাহিনী। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো ভাওরখোলা ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর সরকার পরিবর্তন হলে তিনি আওয়ামী লীগের এলাকার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ২০১৬ সালে ভাওরখোলা ইউনিয়নের সর্বশেষ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়ে চেয়ারম্যান হন।
গ্রামে ফিরে হামলার শিকার
ভাওরখোলার লোকজন জানান, ২০১৬ সালে সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনে আব্বাসীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হন একই গ্রামের বাসিন্দা ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম। নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর আব্বাসী বাহিনীর অত্যাচারে সপরিবার এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন সিরাজুল। আর গ্রামে আসেননি। চাচাতো ভাইয়ের মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত মাসে সপরিবার গ্রামে এসেছিলেন সিরাজুল। এ খবর পেয়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আব্বাসী তাঁর বাহিনী নিয়ে সিরাজুল ইসলামের বড় ভাই আবদুস সালামের বাড়িতে হামলা চালান। এ সময় আব্বাসীর লোকজন নারী-পুরুষ যাকে যেখানে পেয়েছে, পিটিয়ে–কুপিয়ে জখম করেছে। ওই হামলায় নিহত হন সিরাজুলের ভাবি নাজমা বেগম। সিরাজুলের ভাই আবদুস সালামও গুরুতর আহত হন। আবদুস সালাম এখনো ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আব্বাসী গ্রেপ্তার না হওয়ায় চরম আতঙ্কে রয়েছেন বলে গতকাল প্রথম আলোকে জানিয়েছেন সিরাজুল ইসলাম।
মেঘনা থানার ওসি আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, আব্বাসীকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। ওই হামলা ও হত্যার ঘটনায় এ পর্যন্ত নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে ফারুক আব্বাসীর বিরুদ্ধে একটি চাঁদাবাজির মামলার সাক্ষী হওয়ায় নিজের চাচাতো ভাই লিটন আব্বাসীকেও কুপিয়ে আহত করেন তিনি। লিটন এখনো ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না। লিটন আব্বাসী জানান, সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় কিছুই হয়নি, ওই দাপটে এলাকায় ভয়ংকর হয়ে ওঠেন ফারুক আব্বাসী। তিনি জমি দখল, বাড়ি নির্মাণে চাঁদাবাজি, মেয়েদের বিয়ে থেকে চাঁদা আদায়, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদাবাজি—সবই করেন। তিনি সোনারগাঁয়ে একটি ট্রিপল মার্ডারেরও (তিন খুন) আসামি।
তিন খুনের অভিযোগ
আব্বাসীর স্বজনেরা জানান, ২০০০ সালের দিকে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের সুলতান হাজির ছেলে মিজানুর রহমানের সঙ্গে ফারুক আব্বাসীর ছোট বোন লাকী আক্তারের বিয়ে হয়। একপর্যায়ে ওই পরিবারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জের ধরে সুলতান হাজির মেয়ে রীনা (৩০) ও তাঁর দুই সন্তান শাবনী (৭) ও অনীককে (৫) আব্বাসী হত্যা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। ওই ঘটনায় করা মামলার এখনো বিচার শেষ হয়নি।
মামলার বাদী নিহত রীনার ভাই হাবিবুর রহমানের সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলেছেন প্রথম আলোর সোনারগাঁ প্রতিনিধি। হাবিবুর রহমান বলেন, ২০০৩ সালে রীনা আর তাঁর দুই বাচ্চাকে সোনারগাঁ থেকে ঢাকায় নিয়ে যান আব্বাসী ও তাঁর বোন লাকী। এরপর মোহাম্মদপুর এলাকার ডাস্টবিনে লাশ পাওয়া যায় তাঁদের। নিহত শিশু দুটির শরীরেরও সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ ছিল। এ ঘটনায় হাবিবুর সোনারগাঁ থানায় অপহরণ ও হত্যার অভিযোগে মামলা করেন। সেই মামলায় আব্বাসীর দুই ভাই গ্রেপ্তার হলেও ফারুক আব্বাসী গ্রেপ্তার হননি। মামলাটি এখনো নারায়ণগঞ্জ দ্বিতীয় জজ আদালতে বিচারাধীন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ওই মামলার বাদী হাবিবুর রহমান আদালতে লিখিত দিয়েছেন যে ফারুক আব্বাসীর জামিন হলে তাঁর কোনো আপত্তি নেই। এরপর আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পান আব্বাসী। তবে হাবিবুর দাবি করেন, তাঁকে একদিন গাড়িতে তুলে নিয়ে ঢাকার উত্তরায় যান আব্বাসী। অস্ত্রের মুখে ভয়ভীতি দেখান। এরপর আদালতে লিখিত দিতে বাধ্য হন।
আব্বাসীর সাম্রাজ্যে বিব্রত আওয়ামী লীগ
স্থানীয় লোকজন জানান, এলাকায় চাঁদাবাজি করে আব্বাসী বাহিনী। স্থানীয় কৃষকদের জমিতে জোর করে মাছ চাষের (মাছের প্রজেক্ট) অভিযোগ রয়েছে আব্বাসীর বিরুদ্ধে। এ নিয়ে ২০১৯ সালে স্থানীয় কৃষকেরা মেঘনা-হোমনা আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। আব্বাসীর ক্ষমতার উৎস কোথায়, তা নিয়ে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলছেন না। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সফিকুল আলম বলেন, ফারুক আব্বাসী গত ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তবে তিনি দলের কোনো পদে নেই। তাঁর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বিব্রত। আর মেঘনা উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল্লাহ মিয়া রতন শিকদারও বলেন, দলীয়ভাবে তাঁরা আব্বাসীকে নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। আব্বাসী গত নির্বাচনে মিথ্যাচার করে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন আনেন বলে দাবি তাঁর।