মহামারির মধ্যে নতুন অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার যে বাজেট অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল দিয়েছেন, তার ৬১ শতাংশই খরচ হবে সরকার পরিচালন বাবদ। ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৬০৩ কোটি টাকার এই পরিচালন ব্যয় বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১১ শতাংশ বেশি। আর এই টাকার প্রায় অর্ধেক, ১ লাখ ৬৬ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা খরচ হবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, পেনশন এবং সুদ মেটাতে।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ ৬৯ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা চলে যাবে বেতন-ভাতায়, যা মোট রাজস্ব বাজেটের ১৯ দশমিক ০৩ শতাংশ। সুদ পরিশোধে খরচ হবে ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা বা ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ। আর অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন বাবদ ব্যয় হবে ২৮ হাজার ২০৯ কোটি টাকা বা ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। এই তিন খাতের মধ্যে বেতন ও সুদ বাবদ ব্যয় চলতি অর্থবছরের চেয়ে আগামী অর্থবছরে বেশি ধরেছেন অর্থমন্ত্রী।
বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বাজেটে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতায় বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৬৫ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা সামান্য কমে ৬৫ হাজার ৬১৭ কোটি টাকা করেছেন অর্থমন্ত্রী। অর্থাৎ এই খাতে অর্থমন্ত্রী বরাদ্দ বেশি ধরেছেন ৩ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ বেশি।
সুদ পরিশোধে চলতি বছরের বরাদ্দ ছিল ৬৩ হাজার ৭৯৯ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৮ হাজার ৫৮৯ কোটি। এই খাতে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ বেশি ধরেননি অর্থমন্ত্রী। পেনশনে মূল বাজেটের ২৭ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা থেকে কিছুটা কমে ২৭ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা হয়েছে। এই খাতেও অর্থমন্ত্রীকে কিছুটা বেশি বরাদ্দ রাখতে হয়েছে।
এবারে জেনে নিন আপনার প্রতি ১০০ টাকা কর কোথায় কোথায় কোন কোন খাতে কত খরচ হবে। করের সবচেয়ে বড় অংশ খরচ হবে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য মঞ্জুরিতে। সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল হতে এই সাহায্য মঞ্জুরি করা হয়। প্রতি ১০০ টাকা করের ১৯.১ টাকা এই খাতে খরচ করা হবে।
করের টাকার দ্বিতীয় শীর্ষ খরচের খাত সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধের খাত। নতুন অর্থবছরে করের প্রতি ১০০ টাকার ১৯ টাকাই এই খাতে খরচ করা হবে। দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে করদাতাদের প্রতি ১০০ টাকায় খরচ করতে হবে ১৮.৭ টাকা। এটি করের অর্থ খরচের তৃতীয় বৃহৎ খাত। করের ১২.৬ খরচ হবে বিভিন্ন ধরনের ভতুর্কি ও প্রণোদনায় যা খরচের চতুর্থ বৃহৎ খাত।
এছাড়া পণ্য ও সেবা খাতে ৯.৯ টাকা এবং পেনশন পরিশোধে ৭.৭ টাকা খরচ হবে। বিভিন্ন সম্পদ সংগ্রহ করতে গিয়ে খরচ হবে করের ৫.৯ টাকা। পাশাপাশি অনুন্নয়ন ব্যয় ৩ টাকা, অপ্রত্যাশিত ব্যয় ও অন্যান্য ২.৮ টাকা এবং বাকী ১.৩ টাকা বিবিধি খাতে খরচ করা হবে।
শেখ হাসিনার টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকারের তৃতীয় বাজেট বৃহস্পতিবার সংসদে পেশ করেন অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। ৩০ জুন এই বাজেট পাস হবে। ১ জুলাই থেকে শুরু হবে নতুন অর্থবছর। এমন একসময়ে এবার বাজেট দিতে হলো, যখন বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের মহামারিতে অর্থনীতি পড়েছে নাজুক দশায়। ফলে অর্থমন্ত্রীকে বাজেট সাজাতে গিয়ে মানুষের জীবন-জীবিকা বাঁচানোর পাশাপাশি অর্থনীতির ক্ষত সারানোর কথা মাথায় রাখতে হয়েছে।
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ সরকারের ব্যয় স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবছর বাড়ে। অন্য অনেক খাতে বরাদ্দ কমানো গেলেও ঋণের সুদ পরিশোধ এবং বেতন-ভাতায় কাঁচি চালানোর সুযোগ থাকে না। অর্থনীতিতে বাজেটকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় বা পরিচালন বাজেটকে বলে রাজস্ব বাজেট। আর উন্নয়ন বাজেট পরিচিত সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি-এডিপি হিসেবে।
২০২১-২২ অর্থবছরের এই বাজেটে অর্থমন্ত্রী ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা করেছেন। এর মধ্যে পরিচালন ব্যয় বা রাজস্ব বাজেট ৩ লাখ ৬৬ হাজার ৬০৩ কোটি টাকা।
নতুন বাজেটে এ তিন খাতে বেশি অর্থ ব্যয় ধরার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, মুনাফার হার বেশি হওয়ায় গত কয়েক ধরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি অনেক বেড়েছে। সেই সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে সরকারকে। তাতে এ খাতে ব্যয় বেশি হচ্ছে। অন্যদিকে দেশি-বিদেশি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। তার সুদও শোধ করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তাদের প্রতিবছর ইক্রিমেন্ট হয়; তার পেছনেও ব্যয় বাড়ে। অনেকের পদোন্নতি হওয়ায় বেতন বাড়ে। সে কারণে এ খাতেও সরকারের খরচ বাড়বে, এটাই স্বাভাবিক।
‘একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো, এই মহামারির সংকটে অনেকেরই চাকরি চলে গেছে। অনেকের বেতন কমেছে। বিভিন্ন গবেষণায় বলা হচ্ছে, প্রায় আড়াই লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। মোট কথা, দেশের বেশির ভাগ মানুষ খুবই কষ্টে আছে। শুধু বহাল তবিয়তে আছে সরকারি কর্মকর্তারা। তাদের আয় কমেনি; উল্টো ইক্রিমেন্টসহ নানান সুবিধার কারণে বেড়েছে।
‘সে কারণেই সরকারকে তাদের জন্য এই কঠিন সময়েও বেশি খরচ হচ্ছে’- বলেন ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর। মুস্তফা কামাল তার তৃতীয় বাজেটে বেতন ও ভাতা বাবদ যে বরাদ্দ রেখেছেন, তার মধ্যে ১১ হাজার ৯৫ কোটি টাকা কর্মকর্তাদের বেতনে খরচ করবেন। ২৫ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা খরচ করবেন কর্মচারীদের বেতনের জন্য। আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাতার জন্য রেখেছেন ৩২ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা।
সুদ পরিশোধের মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য রাখা হয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। আর বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য রেখেছেন ৬ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা।