বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কাজ আইন ও নীতিমালা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা লঙ্ঘিত হচ্ছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকল নাইনটিনের ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। সেখানে আরো বলা হয়েছে, সাংবাদিক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কর্মী নির্যাতনকারীদের আইনের আওতায় না এনে অব্যাহতি দেওয়া গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য হুমকি।
আজ সোমবার বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস উদযাপনের প্রাক্কালে আর্টিকল নাইনটিনের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২০ সালে করোনার সময় বাংলাদেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে একজন সংবাদকর্মী নিহত ও তিনজন সাংবাদিক অপহৃত হয়েছেন। সংস্থাটির নিজস্ব পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, মোট ৬৩১ জন সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী কোনো না কোনোভাবে প্রভাবশালী পক্ষের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
তাঁদের মধ্যে ২৫৬ জন সাংবাদিক ও ৩৩৮ জন মানবাধিকারকর্মী। এই প্রতিবেদনে দেখা গেছে, তিনটি অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করা হয়েছে বা তাদের তথ্য বা সংবাদ কোনো না কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য সংগ্রহের সময় প্রতিবাদকারীদের দমন-পীড়নের ৩৬টি ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ছয়টি অপপ্রচার বা ঘৃণা ছড়ানোর ঘটনা এই প্রতিবেদনের জরিপে উঠে এসেছে।
আর্টিকল নাইনটিনের বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, ‘সাংবাদিকের নিরাপত্তা, সুরক্ষা ও কল্যাণ প্রশ্নে আমাদের আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও তথ্যের অবাধ প্রবেশযোগ্য নিশ্চিতে সামনে রয়েছে আরো অনেকটা বন্ধুর পথ।’ তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অধীনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান অন্যায্য মামলার ঘটনায় আর্টিকল নাইনটিন উদ্বিগ্ন। কারণ এই পরিস্থিতি সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি।’
প্রতিবেদনের জরিপে দেখা গেছে, সাংবাদিক ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কর্মীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের (২০১৮) আওতায় মামলার ঊর্ধ্বগতি আশঙ্কাজনক। এই পরিস্থিতি মূলত বাংলাদেশের সাংবাদিক, গণমাধ্যমকর্মী ও অনলাইনকর্মীদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সাংবাদিক, গণমাধ্যমকর্মী বা মানবাধিকারকর্মীদের অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়নের জন্য দোষী ব্যক্তিদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার নজির রয়েছে, যা মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বিঘ্নিত করছে।
জরিপে দেখা গেছে, ২০২০ সালে প্রায় ১৬ শতাংশ সাংবাদিক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যাঁদের মধ্যে ১১ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। ৯৬ জন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ৪৭ জন (৭.৪৫ শতাংশ) বিভিন্ন মহলের হুমকি-ধমকির শিকার হয়েছেন। প্রায় ৭২ জন (৭১.৯২ শতাংশ) গণমাধ্যমকর্মী আইনি হয়রানির শিকার হয়েছেন, যা প্রতিবেদনের জরিপের তথ্য থেকে পাওয়া গেছে। তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা হয়েছে। ১১ জনের বিরুদ্ধে করা হয়েছে মানহানির মামলা। অনলাইনে মত প্রকাশের কারণে ৪১০টি মামলা দায়েরের ঘটনা ঘটেছে শুধু ২০২০ সালে।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রায় সব ক্ষেত্রেই সংবাদপত্রে প্রতিবেদন প্রকাশের জের ধরে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। অথচ সাংবাদিকরা দুর্নীতি, নিয়মবহির্ভূত সরকারি কাজ বা স্থানীয় দুর্বৃত্তদের অপকর্মের ঘটনা তুলে আনতে কাজ করেছেন বা করছেন, যা মূলত নাগরিকের তথ্য অধিকার নিশ্চিতের একটি প্রয়াস। সরকারি দলের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার, সরকারের বেআইনি গ্রেপ্তারপ্রবণতা, আটক বা নির্যাতনের ঘটনা বার্ষিক এই প্রতিবেদনে স্থান পেয়েছে। দেশের এই পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে আশঙ্কাজনক।
অন্যদিকে করোনার কারণে মিডিয়া হাউসগুলোর আয় সংকুচিত হওয়ায় ২০২০ সালে এক হাজার ৬০০ সাংবাদিক তাঁদের চাকরি হারান। এ ক্ষেত্রে নারী সাংবাদিকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। মিডিয়া হাউসগুলোর চাকরি নিরাপত্তা ও সুরক্ষা বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় মূলত ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে নারী সাংবাদিকরা আগে চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়েন।